সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার | বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার রচনা

ভূমিকা ঃ মাতৃভাষা মানুষের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা। তাই মানব জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন দার্শনিক, চিন্তাবিদ, মনীষী, কবি-লেখক-শিল্পী মাতৃভাষার গুরুত্বকে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। মাতৃভাষা হলো মন, মনন ও চিন্তনের ভাষা। মানুষের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ মাতৃভাষার মাধ্যমেই যথার্থভাবে প্রকাশিত হয়। ব্যক্তি জীবনের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, সমাজজীবনের শিক্ষা- সংগ্রাম-আন্দোলন-সংস্কার, জাতীয় জীবনের ঐক্য-শৃঙ্খলা, পরিকল্পনা ও কর্মতৎপরতা তথা নাগরিক জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ মাতৃভাষা পালন করে অনন্য সাধারণ ভূমিকা।

বাংলা ভাষা ঃ বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। পৃথিবীর প্রাচীন ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা অন্যতম। বিভিন্ন চরাই-উৎরাই পেরিয়ে এ ভাষা ক্রমশ বিকশিত হয়েছে। এ ভাষায় রচিত হয়েছে মূল্যবান সাহিত্যকর্ম। কিন্তু নানা সময়ে বাংলা ভাষার ওপর বহুবিধ আক্রমণ ও আঘাত এসেছে, বাংলা ভাষার বিকাশকে রুদ্ধ করার অপ্রচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র চলেছে। ব্রিটিশ আমলে এ ভাষা পেয়েছে চরম অবহেলা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরও ১৯৫২ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে এ ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে বাংলার দামাল তরুণদের। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এ ভাষার অবাধ ব্যবহার ছিল তরুণদের প্রধান দাবি।

তৎকালীন দুই পাকিস্তানের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার বিকাশ রুদ্ধ করতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করেছে। এর ফলেই সৃষ্টি হয় ভাষা আন্দোলন এবং মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য ছাত্র-জনতার আত্মদানের বিরল দৃষ্টান্ত। অবশেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলা ভাষাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করলেও বাংলা ভাষা আজো জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহার হচ্ছে না।

পৃথিবীতে বাঙালিরাই সেই গৌরবময় জাতি, যারা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত । । কারণ ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো আমাদের ভাষা শহিদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং বাংলা ভাষার সম্মানে ১৯৯৯ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

বাংলা ভাষা ব্যবহারের সমস্যা ঃ বাংলাদেশ একটি একক ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। বাংলা ভাষা দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে একই বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিকদের সৃষ্টি সম্ভারে বাংলা ভাষা আর বাংলা সাহিত্য আজ ঐশ্বর্যমণ্ডিত। এ ভাষা জীবনের সর্বক্ষেত্রের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। ধ্বনিতাত্ত্বিক দিক থেকেও এ ভাষার কোনো দৈন্য নেই। এজন্যেই বাংলা ভাষা জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে ব্যবহারযোগ্য এবং প্রয়োগে তেমন কোনো সমস্যা নেই। নিম্নলিখিত যেসব সমস্যা আপাত দৃশ্যমান, সেগুলো ভাষাপ্রেমিকদের ঐকান্তিক প্রয়াসে দূর করা সম্ভব। যেমন ঃ

ক. বাংলা পরিভাষার জটিলতা এবং মানসম্পন্ন অনুবাদ শব্দ ব্যবহারে অদক্ষতা।

খ. সরকারি চিঠিপত্রে সাধু ভাষার ব্যবহার ।

গ. আইন-কানুন, নিয়ম-বিধি এবং বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসাবিষয়ক শব্দাবলির অনুবাদে অসুবিধা ।

ঘ. ইংরেজি থেকে বাংলা উত্তরণের মনস্তাত্ত্বিক জড়তা।

প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ঃ এসব সমস্যা উত্তরণে বিভিন্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাংলা একাডেমী থেকে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলা পরিভাষা পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এগুলো অপ্রতুল। তাছাড়া কিছু সংখ্যক ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহারোপযোগী নয়। আবার অনেক পরিভাষার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কেও প্রচুর সন্দেহ রয়েছে। বাংলায় যথাযথ অনুবাদের জন্য মানসম্পন্ন শব্দাবলি প্রয়োজন। আর প্রয়োজন দেশের প্রধান প্রধান পণ্ডিতদের সমন্বয়ে ভাষার একটি ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত বিধান এবং এর প্রয়োগ ও ব্যবহারে দেশের সর্ব শ্রেণির ও পেশার মানুষের আন্তরিকতা। তাছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রে পাণ্ডিত্যপূর্ণ পরিভাষা ব্যবহার করলেও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক পরিভাষার প্রয়োজন সমধিক।

বাংলা টাইপ রাইটারের স্বল্প গতি বাংলা ভাষা ব্যবহারে বিশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতায় বাংলা টাইপ রাইটারের গতি বৃদ্ধি এবং মান উন্নয়নে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। অন্যদিকে, মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে এ যাবৎ অফিস-আদালতে ইংরেজি জানা টাইপিস্টদের অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে। এ মনোভাব পরিহার করা উচিত। যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে বাংলা টাইপিস্টরা যথেষ্ট দক্ষতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে। অবশ্য বর্তমানে কম্পিউটারের ব্যবহারের ফলে এ সমস্যা অনেকাংশেই দূরীভূত হয়েছে।

বর্তমানে অফিস-আদালতে সাধু ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু সাধু ভাষা ব্যবহারিক কাজে বর্তমানে প্রায় পরিত্যক্ত। কথোপকথন, সংবাদপত্র, সৃষ্টিশীল গ্রন্থরাজি ও পাঠ্য-পুস্তকাদির প্রায় সর্বস্তরে ইতোমধ্যে চলিত ভাষা স্থান গ্রহণ করেছে। তাই অফিস-আদালতে চলিত ভাষা চালু হলে বাংলার প্রচলন ও ব্যবহার আরো দ্রুত হবে । বাংলায় অনুবাদ না করায় উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে এখনো ইংরেজির প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং আইন ও প্রশাসনিক বিধিবিধানের ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনে বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করছে।

অফিস-আদালতে, উচ্চতর শিক্ষা ও বিশেষ বিশেষ পরীক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ইংরেজি থেকে বাংলায় উত্তরণের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। আমাদের ঔপনিবেশিক আমলের চিন্তা-পরিপুষ্ট মানসিকতা চিরকালই স্বদেশের শিক্ষা- সংস্কৃতি-ভাষা থেকে বিদেশের ভাষা-সংস্কৃতিকে বড় করে দেখেছে। তাছাড়া শ্রেণিবৈষম্য টিকিয়ে রাখার জন্য সুবিধাবাদী শিক্ষিত শ্রেণি আজো ইংরেজি ভাষার পক্ষে দুর্বলতা পোষণ করছেন।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারে সুপারিশ ঃ উল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক ঃ

১. শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে সর্বজনীনভাবে ব্যবহার করার লক্ষ্যে সকল শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের উপযোগী বাংলা পুস্তক রচনা ও প্রকাশ প্রয়োজন । কলেজ ও উচ্চশিক্ষার পাঠ্যপুস্তক অনুবাদ, রচনা ও প্রকাশনার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। কিন্ডারগার্টেন সিস্টেমের স্কুলসমূহের ইংরেজি বইয়ের আধিপত্য কমিয়ে এবং বাংলা বইয়ের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা ভাষা চর্চায় সকলকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন ।

২ . যথার্থ পরিভাষা না পেলে বিদেশি শব্দগুলো অস্থায়ীভাবে বাংলায় রাখা কিংবা আত্তীকরণ করা যেতে পারে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভাগ ও অফিস-আদালতে ব্যবহৃত ও চালু প্রতিশব্দগুলো একত্র করে একটি কার্যকর পরিভাষা কোষ তৈরি করা যেতে পারে।

৩. নিম্ন-আদালতে জমিজমা বা রাজস্বের ক্ষেত্রে আরজি, সমন, সওয়াল-জবাব বাংলায় যেমন হচ্ছে, উচ্চ আদালতেও তেমনটি হওয়া

সম্ভব। এজন্য যাবতীয় আইনের বাংলা অনুবাদের জন্য একটি সংস্থা বা কমিশনের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে।

8. সকল ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানে লেনদেন, হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি ও বাণিজ্যিক কাগজপত্র বাংলায় চালু করা যেতে পারে। এতে দেশের অর্থনৈতিক বিষয়াদির সঙ্গে সর্বস্তরের জনগণের সম্পর্ক দৃঢ় ও গভীর হবে।

৫. শুধু ইংরেজি ভাষা নয়, বাংলা ভাষা উত্তমরূপে জানলে চাকরির নিশ্চয়তা বিধান করা হবে- এরকম ধারণা ও সিদ্ধান্ত নিয়ে সব অফিস-আদালতে চাকরির পরীক্ষায় বাংলার প্রতি বেশি গুরুত্ব প্রদান করলে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে দ্রুত বাংলা ব্যবহার সম্ভব।

৬. প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে চাপ সৃষ্টি অব্যাহত থাকলে সর্বস্তরে বাংলা চালু দ্রুত সম্পন্ন হবে। অফিস-আদালতের সর্বপর্যায়ে বাংলা প্রচলনের জন্য ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদে আইন প্রণীত হয়েছে। সে আইন সকলে মেনে চললে সুফল ফলবে।

৭. সর্বোপরি মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং এর প্রসারে বিভিন্ন ব্যবহারিক কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে এবং বাংলা ভাষার বিস্তারে বাংলা একাডেমীকে আরো সম্প্রসারিত করা যেতে পারে।

উপসংহার ঃ জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারে আইন আর আন্তরিকতা একসঙ্গে মিলিত হলে সর্বস্তরে এটি দ্রুত প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম, আন্দোলন এবং আত্মাহুতির পর বাংলা ভাষা আজ স্বমহিমায় দীপ্তিমান এবং বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধার আসনে আসীন। এই দীপ্তি আরো উজ্জ্বল হবে সেদিন, যেদিন সর্বস্তরের মানুষ আন্তরিকভাবে বাংলা ভাষা জীবনের সর্বত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাবে, বাংলা ভাষাবিরোধী সকল মনোভাবকে বিসর্জন দেবে।

সবগুলো রচনা একসাথে দেখতে এখানে চাপ দিন

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ফিউচার ড্রীম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url