জনসেবা বাংলা রচনা | বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা
জনসেবা
ভূমিকা ঃ কেবল জন্ম নিয়েই মানুষ মানুষ হয়ে ওঠে না। মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনায় তাকে ব্রতী হতে হয়। জনসেবা সেই ব্রতেরই অংশ। কারণ, অরণ্যচারী মানুষ যখন সমাজবদ্ধ জীবনের সূচনা করেছে তখন থেকেই বৃহত্তর কল্যাণ চেতনা হয়েছে মানুষের চলার পথের পাথেয়। আত্মস্বার্থমগ্নতা নয়, অন্যের জন্য আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই মানুষ উড্ডীন করেছে মনুষ্যত্বের গগনচুম্বী পতাকা। অন্যের কল্যাণে এই আত্মত্যাগের ব্রতের নামই জনসেবা ।
জনসেবার স্বরূপ বৈশিষ্ট্য ঃ সহজ কথায় জনগণের সেবাই জনসেবা। অর্থাৎ সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধনের জন্য কর্ম পরিচালনা, ভূমিকা পালন কিংবা অবদান রাখাই জনসেবা। সুপ্রসিদ্ধ লেখক রাস্কিন-এর মতে, ‘পৃথিবীতে মানুষের কর্তব্য-কর্ম তিনটি : 'Duty towards God, duty towards parents and duty towards mankind.' মানবকল্যাণের কর্তব্যই জনসেবা। জনসেবার ধারণা কেবল অসহায় জনগণের সেবার মধ্যেই সীমিত নয়। আবার কেবল মানবকল্যাণই জনসেবা নয়। তাহলে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা, কল-কারখানা স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পাদন ইত্যাদিও সেই অর্থে জনসেবা গণ্য বলে হতে পারে।
আরো পড়ুন ঃ ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য রচনা
সাম্প্রতিককালে খ্যাতি বা প্রতিষ্ঠা লাভের কৌশল হিসেবে কেউ কেউ সংসদীয় নির্বাচনে বা স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনে জয়লাভের আশায় নিজের নির্বাচনি এলাকায় রাস্তাঘাট মেরামত, নলকূপ বসানো, স্কুল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কাজ করে থাকেন। অথচ পাশের এলাকায় এসব অধিকতর প্রয়োজনীয় হলেও সেদিকে নজর দেন না। একেও প্রকৃত জনসেবার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা মুশকিল। বস্তুত, নিজের স্বার্থের দিকটি উপেক্ষা করে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণের যথাসম্ভব কল্যাণ বা সেবাই হচ্ছে জনসেবা। আরও ব্যাপক ও বৃহত্তর অর্থে দেশে দেশে বিপন্ন মানবতার সেবা করাও জনসেবার পর্যায়ে পড়ে ।
সেবাব্রতের প্রাচীন ঐতিহ্য ঃ মানুষের সেবাব্রতের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। সেকালে তা ব্যাপক অভিব্যক্তি পেয়েছিল ধর্মীয় চেতনার আশ্রয়ে। কোরান, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্রে জনসেবাকেই ধর্ম সাধনার প্রকৃত পথ বলে বিবেচনা করা হয়েছে। মানব সভ্যতার বিভিন্ন কালপর্বে মহান ধর্মসাধকরাও জনসেবার আদর্শ প্রচার করে গেছেন। মহানবী হযরত মুহম্মদ (স) বলেছেন, 'সব কাজের মধ্যে সমাজকল্যাণের কাজই শ্রেষ্ঠ।' জীবজগতের দুঃখ দূর করার ব্রত নিয়ে গৌতম বুদ্ধ রাজ সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন। “জীবে দয়া করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।' কবি ‘সবার পিছে, সবার নিচে সবহারাদের মাঝে দেবতার চরণধ্বনি শুনতে পেয়েছেন। মানুষ উপলব্ধি করেছে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।'
জনসেবার নানা রূপ ঃ জনসেবা নানাভাবে করা যায়। মানবকল্যাণে অর্থ ও সম্পদ ব্যয়, শ্রম ও শুশ্রূষা প্রদান, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে সহায়তা, দুস্থ ও বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি সবই জনসেবার অঙ্গ। কবি রজনীকান্ত সেন তাঁর একটি কবিতায় জনসেবার নানা বৈশিষ্ট্যময় প্রকারভেদকে তুলে ধরেছেন এভাবে-----
অন্নহীনে অনুদান, বস্ত্ৰ বস্ত্রহীনে,
তৃষাতুরে জল দান, ধর্ম ধর্মহীনে,
মূর্খজনে বিদ্যাদান, বিপন্নে আশ্রয়,
রোগীরে ঔষধ দান, ভয়ার্তে অভয়,
গৃহহীনে গৃহদান, অন্ধেরে নয়ন,
পীড়াতে আরোগ্য দান, শোকার্তে সান্ত্বনা,
স্বার্থশূন্য হয় যদি এ দ্বাদশ দান
স্বর্গের দেবতা নহে দাতার সমান ।
আরো পড়ুন ঃ
নিঃস্বার্থ সেবা মনুষ্যত্বের লক্ষণ ঃ মানুষ সৃষ্টি সেরা জীব। শ্রেষ্ঠত্ব তার অন্তরে নিহিত। অন্তরের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে মানুষ মানুষকে ভালোবাসতে শেখে, তার সেবা করতে শেখে। এ শিক্ষা জনসেবার শিক্ষা। মানুষের এ এক মহত্তম গুণ। স্বার্থপরতা কখনও মানুষের গুণ হতে পারে না। কেবল নিজ পুত্র-কন্যা-স্ত্রী তথা আপন সংসার নিয়ে নিমগ্ন জীবন কখনও সার্থকতা ও পরিপূর্ণতা পায় না । রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন
‘স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে
সে কখনও শেখেনি বাঁচিতে।'
সব মানুষের জীবন এক রকম নয়। মানুষের জীবন বৈচিত্র্যময়। হাসি, আনন্দের সাথে অভাব-অনটন, দুঃখ-দৈন্য, হতাশা, মৃত্যু, শোক ইত্যাদি প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনকে কশাঘাতে জর্জরিত করছে। মানুষকেই মানুষের এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে, মানুষের কল্যাণে জীবনকে উৎসর্গ করতে হবে, তবেই এ জীবন সার্থক ও সফল হবে। কেননা
‘সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।'
অনাড়ম্বর জনসেবাই প্রকৃত জনসেবা। নাম, যশের জন্য যে জনসেবা তা কখনও অকৃত্রিম হয় না। জনসেবার জন্য কখনও সভা-সমিতি বা প্রচারেরও প্রয়োজন পড়ে না। স্বার্থপর ও অর্থলিপ্সু লোকজন জনসেবার নামে মানুষকে প্রতিনিয়ত প্রতারিত করছে। কখনও বা জনকল্যাণের নামে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে। এ বিষয়ে সবাই সচেতন ও সদাজাগ্রত থাকতে হবে।
জনসেবা ও সেবা প্রতিষ্ঠান ঃ মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং কার্যক্রমের ব্যাপক উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিভিন্ন সংঘ, সমিতি, বেসরকারি সংস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জনসেবামূলক নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। বিশ্ব সম্প্রদায়ও মানব জাতির উন্নয়ন ও কল্যাণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বমানবতার সেবা অসহায় মানুষের মনে নতুন করে বাঁচার আগ্রহ সৃষ্টি করছে।
আরো পড়ুন ঃ
উপসংহার ঃ জনসেবা মানুষের এক মহৎ হৃদয়বৃত্তি, অনন্য মানবধর্ম। সেবাপরায়ণতা মানুষের মনকে মহান ও উদার করে। উদার মন মানুষের জীবনে আনে অনাবিল সৌন্দর্য, আনে শান্তি ও সুখ। সুতরাং, জনসেবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই মানুষ এই শান্তি ও সুখ পেতে পারে। অন্যের দুঃখ মোচনের মাধ্যমে নিজের জীবনের সত্যিকারের সুখকে খুঁজতে পারে মানুষ। কবির ভাষায়-----
‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
সবগুলো রচনা একসাথে দেখতে এখানে চাপ দিন
ফিউচার ড্রীম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url