হযরত মহানবী সাঃ এর জীবনী রচনা pdf | বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা
হযরত মুহাম্মদ (স)
মহাপুরুষের কেউই একে অপরের মতো নন, প্রত্যেকেই তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসাধারণ এবং প্রত্যেকে প্রত্যেক থেকে স্বতন্ত্র। নিজের দেশ ও সময়ের মানুষ হয়েও কর্ম ও অর্জনের মধ্য দিয়ে তাঁরা সারা পৃথিবীর আদর্শ ও উত্তরাধিকারে পরিণত হন। হযরত মুহাম্মদ (স) আরব দেশের এক অন্ধকার যুগে জন্মগ্রহণ করেন, সেখানে তিনি আগুনের এমন একটি শিখা প্রজ্বলিত করলেন, যা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর প্রচারিত ধর্মমতের গুণাবলি আজো সমস্ত বিশ্বের বিস্ময় ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। সেই সঙ্গে তাঁর নিজের চরিত্রের যে আকর্ষণ সেটিও সবদিক দিয়েই অসাধারণ বটে। এর কারণ মানুষ হিসেবে তিনি অসাধারণ ছিলেন।
হযরত মুহাম্মদ (স) বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি একজন মানুষ, তাঁর কোনো অলৌকিক শক্তি নেই। মানুষ হিসেবে মানবিক গুণগুলোকে এমনভাবে তিনি বিকশিত করে তুলেছিলেন যে তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করার আগে লোকে তাঁকে গ্রহণ করেছে সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য একজন নেতা ও আদর্শ পুরুষ হিসেবে। ফুলের সুবাস যেমন আপনা-আপনি ছড়িয়ে পড়ে তেমনি ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর চরিত্রের মাধুর্যের সুসংবাদ। কেবল তাঁর দেশের নয়, তাঁর কালের নয়, সব দেশের সব কালের মানুষ এই অসামান্য মানুষটিকে শ্রদ্ধা করে এসেছে, এখনও করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। তিনি মানুষের ভালো করতে চেয়েছেন, মানুষকে করুণা করে নয়, ভালোবেসে।
আরো পড়ুন ঃ আমার প্রিয় কবিঃ কাজী নজরুল ইসলাম রচনা
৫৭০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু। তিনি এসেছিলেন তাঁর দেশের এক দুঃসময়ে। তাঁর আশপাশের মানুষেরা তখন অনাচারে পঙ্গু, অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় আচ্ছন্ন এবং নানা প্রকার দ্বন্দ্বে বহুধা-বিভক্ত। নিজে তিনি দরিদ্র ছিলেন। পিতা মারা যান তাঁর জন্মের আগে, মা মারা গেলেন যখন বয়স মাত্র ছয়, দাদা চলে গেলেন আট বছর বয়সে। প্রকৃতপক্ষেই এতিম ছিলেন তিনি। তাঁকে রাখালের কাজ করতে হয়েছে। সিরিয়াতে গিয়েছিলেন তিনি একবার একজন ধনী বিধবা মহিলার ব্যবসার প্রতিনিধি হিসেবে। এমন ছিল তাঁর সততা যে, মুগ্ধ হয়ে এই মহিলা তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন । ধনেতো বটেই বয়সেও বিবি খাদিজা বড় ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (স)-এর, কিন্তু তাঁর পূর্ণ আস্থা জন্মেছিল নিজের তরুণ কর্মচারীটির উপর।
এই আস্তা হযরত মুহাম্মদ (স) যখন যেখানে গেছেন অতি অনায়াসে অর্জন করেছেন। তাঁকে বলা হতো 'আল-আমিন' অর্থাৎ বিশ্বাসী । তাঁর জীবন নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস। মানুষের মনুষ্যত্ব যে প্রকৃতি ও পরিস্থিতির কাছে সমর্পিত নয়, আছে তাদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায়—এ সত্য তাঁর জীবনে অত্যন্ত উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত। প্রথম বয়সে তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। কিন্তু এর চেয়ে অনেক বড় সংগ্রাম তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। সেটি শুরু হয় যখন থেকে তিনি তাঁর মতবাদ প্রচারে ব্রতী হলেন। তাঁকে লড়তে হয়েছে অত্যন্ত আপজনদের বিরুদ্ধে।
আত্মীয় শত্রু হলো, প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি যতভাবে পারে হয়রানি আরম্ভ করলো। বাধ্য হয়ে তাঁকে জন্মভূমি পরিত্যাগ করে মদিনা শহরে চলে যেতে হলো। এতে তাঁর শক্তি কমলো না, বরঞ্চ বাড়লো। তার চরিত্রের মাধুর্য ও ধর্মমতের মহত্ত্ব নতুন নতুন মানুষকে আকর্ষণ করলো তাঁর দিকে। আলোকে উদ্ভাসিত, নবীন বিশ্বাসে উদ্দীপ্ত মানুষদের নিয়ে সাত বছর পরে মক্কায় ফিরে এলেন তিনি। আপোস করে নয়, যুদ্ধ করে বিজয়ীর বেশে। অস্ত্রের বিজয় নয়, মতাদর্শের বিজয় আসলো, যদিও যুদ্ধের অত্র অবশ্যই ব্যবহার করা হয়েছিল, যেমন সব যুদ্ধেই করা হয় ।
বিজয়ী হযরত মুহাম্মদ (স) রাষ্ট্র পরিচালনায় অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শন করলেন। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিন্তু অতুলনীয় ছিল জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আর ছিল সাংগঠনিক শক্তি। এই শক্তি কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, প্রকাশ পেয়েছে জাতি গঠনেও, ছাপ রেখেছে রাষ্ট্র পরিচালনাতেও বটে। এবং ধৈর্য ছিল অসাধারণ। জীবনের কোনো অবস্থাতেই হতাশ হননি, কোনো প্রতিকূলতাতেই অস্থির হয়ে পড়েননি কখনও। তিনি জানতেন যে, মিথ্যের উপরে সত্যের জয় রাত্রিশেষে দিনের আগমনের মতোই অবশ্যম্ভাবী। মুহূর্তের জন্যও স্বীয় আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলেন না এবং আপোস করলেন না অন্যায় ও মিথ্যের সঙ্গে। প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করতে হবে- --এ ছিল বিশ্বাস তাঁর নিরুপম মনস্কতারই প্রতিফলন।
আরো পড়ুন ঃ একটি ছুটির দিন রচনা
অথচ ফুলের মতো কোমল ছিলেন এই মহাপুরুষ। শিশুর মতো সরল। প্রয়োজনে যিনি পর্বতের ন্যায় অনড় হতে জানতেন তাঁর মধ্যেই ছিল ফুলের কোমলতা, শিশুর সরলতা। কোমলে-কঠোরে এই অতি দুর্লভ মিলনের কারণেই তিনি নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে নিরুপম ছিলেন বটে সব সময়েই, কিন্তু ব্যক্তিগত আচরণ ও ব্যবহারে স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না কখনোই। সত্যের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ছিল একান্ত মানবিক; তা তাঁকে অহঙ্কারী করেনি কখনও। বিজয়ী বেশে যখন তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন, পরাজিত মক্কাবাসী তখন আশঙ্কা করেছিল তিনি সেখানে রক্তের বন্যা বইয়ে দেবেন।
কেবল সেকালের নয় যেকোনো কালের মানদণ্ডে সেটাই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু বিস্মিত মক্কাবাসী দেখলো, তিনি সেদিকে মোটেই গেলেন না, বরঞ্চ ক্ষমা করে দিলেন, কাছে টেনে নিলেন, শত্রুকে মিত্র করে তুললেন। নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বে তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তিনি আবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন অনুসারীদেরকে যে, ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। ভূমিজয়ে বিশ্বাস করতেন না, হৃদয়জয়ে বিশ্বাস করতেন। তাঁর পথে কাঁটা বিছানোর প্রতিদিনকার কাজে অনুপস্থিত বৃদ্ধার যে তিনি খোঁজ
নিতে গিয়েছিলেন এ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না তাঁর জন্য। ওই ছিল দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যক্তিগত শত্রুরও তিনি ছিলেন মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। যা বলতেন তা কেবল বিশ্বাসই করতেন না, তদানুযায়ী আচরণও করতেন। সেই শিশুটিকে তিনি চট করে মিষ্টি খেতে বারণ করতে পারেননি, যাকে তার পিতামাতা তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিল সংশোধনের জন্য; বারণ করলেন পরের দিন, নিজে মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দেবার পরে । তিনি যদি মানুষের শ্রদ্ধা আকর্ষণ না করেন তবে কে করবে?
আরো পড়ুন ঃ হরতালের একটি দিন রচনা
তাঁর সময়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত আরববাসীরা নিজেদের গড়া মূর্তিকে নিজেরাই পূজা করতো, হযরত মুহাম্মদ (স) পৌত্তলিকতার অবসান ঘটিয়ে নৈতিক ও মানসিকভাবে মুক্তি করে দিলেন সেই মানুষদের। সেখানে মেয়েদের কোনো মর্যাদা ছিল না, কন্যা সন্তানের জন্ম হলে পিতামাতার মুখ শুকাতো, তাকে অনেক সময় জ্যান্ত পুঁতে ফেলতো তারা ভবিষ্যতের কথা ভেবে, সেখানে তিনি মেয়েদের পুরুষের সমান মর্যাদা দিলেন। তাঁর ভূমিকা কেবল ধর্মবিপ্লবীর ছিল না, ছিল সমাজবিপ্লবীরও। আরবে তখন দাসপ্রথা ছিল; হযরত মুহাম্মদ (স) তার অবসান ঘটালেন । তিনি নিয়ে এলেন সাম্য ও মুক্তির বাণী, যে জন্য দলে দলে লোক ছুটে এলো তাঁর ধর্মমতের দিকে। ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে পড়ল দেশে দেশে। যেখানেই গেলেন তিনি আঘাত করলেন রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রকে।
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবন একটি আদর্শ জীবন। কেমন করে নিষ্ঠা, সততা ও সংগ্রামশীলতার মাধ্যমে জয়ী হওয়া যায়, কেমন করে মঙ্গল করা যায় মানুষের এবং ভালোবাসা পাওয়া যায় সকলের তার এক দুর্লভ আদর্শ তিনি তুলে ধরেছেন সারা বিশ্বের মঙ্গলের জন্য।
[বিঃদ্রঃ-এটি নন্দন গাইড বই থেকে সংগৃহীত]
সবগুলো রচনা একসাথে দেখতে এখানে চাপ দিন
ফিউচার ড্রীম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url