একটি বটগাছের আত্মকথা প্রবন্ধ রচনা | বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা

একটি বটগাছের আত্মকাহিনি

একটি বটগাছের আত্মকাহিনি

বহু বছর ধরে আমি স্থির দাঁড়িয়ে আছি। আমি নিজেও জানি না আমার বয়স কত। একশ বছর কিংবা তার বেশি তো হবেই আমি দাঁড়িয়ে আছি নদীর ধার ঘেঁষে তোমাদেরই লোকালয়ে। অনেক বছরের ঘটনার আমি নীরব দর্শক। অনেক স্মৃতি, অনেক অভিজ্ঞতা, অনেক আনন্দ, অনেক দুঃখের সাক্ষী আমি। অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে আমার ওপর দিয়ে। তবু এখনো আমি ঠায় দাঁড়িয়ে।

প্রায় শত বছর আগের কথা। আমি তখন ছোট। সে সময় কত না পাখি আমার ডালে এসে বসত, কলকাকলিতে মুখরিত করত, কেউ কেউ আমার ডালে বাসা বাঁধত। তাদের বর্তমান বংশধরদের কাছে এখনো আমি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। তারা এখনো আসে দল বেঁধে। গান গায়, বাসা বাঁধে, ছানা ফোটায়। তবে সংখ্যায় তারা এখন অনেক কম। বুঝতে পারি ওদের কলকাকলির অর্থ। ঝড়ের রাতে আমি ওদের ছোট বাসাগুলোই আমার ডালপালা দিয়ে রক্ষা করি। আমার বিশাল শরীর বেয়ে কোনো হিংস্র প্রাণী ওপরে উঠতে পারে না। তাই ওরা নিশ্চিন্তে ডিম পাড়ে।

আরো পড়ুন ঃ একটি নদীর আত্মকথা প্রবন্ধ রচনা

বাচ্চা ফোটায়। একসময় সেই বাচ্চাগুলো বড় হয়, উড়তে শেখে। পাড়ি জমায় অজানা জায়গায়। অনেক দিন পর তারা আবার হয়তো ফিরে আসে। তখন তারা অনেক বড় হয়ে গেছে। তারা এবার বাসা বাঁধে, ডিম পাড়ে। এভাবে বছরের পর বছর ধরে আমি পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে আছি। আমার ডালে খেলে বেড়ায় কাঠবিড়ালিরা। পাখির কলকাকলি আর কাঠবিড়ালির চঞ্চল ছুটাছুটিতে সারাটা দিন আমার চারপাশ এখনো একটা কিছুতে উৎসবমুখর।

কেবল তোমরা মানুষরাই এর মধ্যে অনেক বদলে গেছ। বদলে ফেলেছ তোমাদের চারপাশের পরিবেশকেও। বেশ মনে পড়ে, আমার ছোটবেলায় এ এলাকাটি ছিল সুন্দর শান্ত একটি গ্রাম। আমার কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি ছিল স্নিগ্ধ জল ভরা। তাতে ভাসত কত নৌকা। আমার পাশে পাশে ছিল আরো কত গাছ। আমরা নদীর তীরে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে তোমাদের ছায়া দিতাম, শোভা দিতাম। আর বন্যার সময় পাড় ভাঙার হাত থেকে তোমাদের গ্রামটিকে রক্ষা করতাম। তখন তোমরাও আমাদের ভালোবাসতে। রাখাল এসে বসত আমার ছায়ায়। ক্লান্ত পথিক এখাসে বসে বিশ্রাম নিত। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখানে খেলা করত। আমার ডাল ধরে তারা

লাফিয়ে পড়ত নদীর পানিতে। রাতে মাঝে মাঝে এখানে বসত পালাগানের আসর। কত লোকই না আসত সেইসব পালাগান শুনতে। যে রাতে পালাগান হতো না, জোনাকিরা সারা রাত আলো জ্বালিয়ে উড়ত, অন্ধকারে ভেসে আসত ব্যাঙের ডাক, ঝিঝি পোকার একটানা সুর। সপ্তাহে দুদিন এখানে হাট বসত। আশপাশের গ্রাম ও নদীর ওপাড় থেকে হাটুরেরা আসত এখানে। সন্ধ্যার পরও কুপি জ্বালিয়ে কেনাবেচা চলত । তখন কত সহজ ছিলে তোমরা, কত সুন্দর আর মমতাঘেরা ছিল তোমাদের জীবন ।

আরো পড়ুন ঃ বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ রচনা

তারপর কখন যেন পালাবদল শুরু হলো। গ্রামে ছোঁয়া লাগল নগরায়ণের। একটি মাত্র ইটের ভাটা বদলে দিল তোমাদের জীবনধারা, বদলে দিল তোমাদের পরিবেশ। ইটের ভাটা তৈরির পর শুরু হলো ইট, সিমেন্ট লোহা-লক্কড়ের আনাগোনা। শুরু হলো বাস-ট্রাকের আনাগোনা। তৈরি হলো পাকা বাড়ি, তৈরি হলো কলকারখানা। বদলে গেল তোমাদের পেশা। তোমরা হলে শ্রমিক। কলকারখানা শুরু হবার পর এখানে এলো শহরের বাবু-সাহেবরা।

লোভী মানুষের প্ররোচনায় তোমরা একে একে সব গাছ কেটে ফেললে। তবু বোধহয় তোমাদের কিছুটা হলেও মমতা ছিল। তাই আমি কোনোভাবে রক্ষা পেলাম। হয়তো তোমাদের বদলে যাওয়া দিনগুলোর সাক্ষী হিসেবেই তোমরা আমাকে টিকিয়ে রেখেছ। আর আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাদের নানা পরিবর্তন।

এখন গ্রীষ্মকালে নদী যায় শুকিয়ে। নদীতে আর নৌকা ভাসে না। এখন আর আমার ডাল ধরে তোমাদের ছেলেমেয়েরা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। মাঝে মাঝে তারা আসে পাখির ডিম চুরি করতে, ছানা ধরতে, আমার ডাল ভাঙতে। তোমরা কলকারখানার নোংরা জিনিস ফেলে নদীর পানিকে করে ফেলেছ দূষিত। গ্রামের লোকেরা হয়ে পড়েছে শহরমুখী । গ্রাম হয়ে পড়েছে উপশহর ।

তোমরা আর গ্রামকে, গ্রামের নদীকে ভালোবাস না। এখন আর আমার এখানে পালাগানের আসর বসে না। টেলিভিশন আর ক্যাসেট প্রেয়ার তোমাদের মনকে বদলে দিয়েছে। তোমাদের মনকে বদলে দিয়েছে স্বার্থ হাসিলের নেশা, অর্থবিত্তের লোভ। আর এর ফলে মমতার বন্ধনকে তোমরা হারাতে বসেছ।

এখন ইটের ভাটা আর কলকারখানার ধোঁয়ায় এখানকার পরিবেশ হয়ে পড়েছে বিষাক্ত। গাছপালা কারো হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেও কষ্ট পাচ্ছি। কারখানার বিষাক্ত ময়লা নদীর পানিতে মিশে নদীর পানি হয়ে গেছে নষ্ট। তোমাদের নদীতে মাছ মরে যাচ্ছে। তোমাদেরও কষ্ট বাড়ছে, অসুখ বাড়ছে।

আরো পড়ুন ঃ বাংলাদেশের কৃষক রচনা

এরপরও আমি তোমাদের ভালোবাসি। তোমরা চলাচল করতে পার, কথা বলতে পার। তোমরা আমার মতো নিশ্চল নও, নির্বাক নও। তোমাদের কত বুদ্ধি, কত জ্ঞান। তাই তোমরাই পার এই সমস্যা সমাধান করতে। তোমরাই পার আবার অনাবিল শান্তির দিন ফিরিয়ে আনতে, পার মমতার বন্ধনে সবাইকে আবার মিলিত করতে। তোমাদের সেই ভালো দিনগুলো দেখার আশায় আমি আজও বেঁচে আছি। সেই দিনগুলোতেও আমি তোমাদের পাশে থাকতে চাই ।

সবগুলো রচনা একসাথে দেখতে এখানে চাপ দিন

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ফিউচার ড্রীম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url