বর্তমান সভ্যতায় বিদ্যুতের ভূমিকা রচনা | বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা
বর্তমান সভ্যতায় বিদ্যুতের ভূমিকা রচনা
ভূমিকা ঃ বৈজ্ঞানিক ফ্যারাডে আবিষ্কার করেন বিদ্যুৎ। সৃষ্টির আদিম প্রভাতে আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখে অসহায় ভয়ার্ত মানুষ তাকে কোনো অলক্ষিত শক্তি ভেবে অরণ্য অথবা গুহার নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপন করেছিল। আধুনিক কালের বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান মানুষ তাকে জয় করেছে। সকল শক্তির উৎস বিদ্যুৎকে যে আলাদিনের প্রদীপের দুর্ধর্ষ দৈত্যের মতো বশীভূত করে তাকে নিয়োজিত করেছে মানুষের একনিষ্ঠ সেবায়-সভ্যতার সার্বিক বিকাশে ।
বর্তমান সভ্যতা বিদ্যুৎ-নির্ভর ঃ বিদ্যুৎ যে শুধু আকাশেই ছিল তা নয়। সর্বত্রগামী বিদ্যুতের উপস্থিতি রয়েছে জড়-জগতের প্রতিটি ক্ষেত্রে। এই দুর্লভ সত্যটি উপযুক্ত পরীক্ষার দ্বারা আচার্য জগদীশচন্দ্র প্রমাণ করলেন যে, সমস্ত জড়-জগৎকে ঘিরে রয়েছে সর্বশক্তিধর বিদ্যুৎ । আসলে অসীম শক্তিশালী বিদ্যুতের এক বিশাল মহাসমুদ্রে এই জড়-জগৎ নিত্য-ভাসমান। এই দুর্জয় বিদ্যুৎকে করায়ত্ত করে মানুষ ধীরে ধীরে সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখা মুছে ফেলেছে । বিদ্যুৎ-শক্তির বিচিত্র কার্যকারিতার উপর রচিত হয়েছে বর্তমান সভ্যতার সুদৃঢ় বুনিয়াদ ।
আরো পড়ুন ঃ
আজকের মানুষ এত বেশি বিদ্যুৎ-নির্ভর যে, বিদ্যুতের ব্যবহার ছাড়া তার আর একপাও অগ্রসর হওয়ার উপায় নেই। বিদ্যুৎই আধুনিক বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে পৌঁছে দিয়েছে শব্দধিক (supersonic) যুগে এবং জৈব প্রযুক্তির (Bio-technology) অসীম সম্ভাবনাময় যুগের দ্বারপ্রান্তে। বিজ্ঞানের সোনার কাঠি হচ্ছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎবিহীন বর্তমান সভ্যতা হয়ে পড়বে অনুজ্জ্বল, নিথর ও নিষ্প্রাণ। বিদ্যুৎ ছাড়া সভ্যতার সমস্ত গতি ও প্রযুক্তি নিমেষে থমকে যায় । সেই জন্যই বিদ্যুৎকে বলা হয় আধুনিক প্রযুক্তির ধাত্রী ।
দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের অবদান ঃ আকাশের বিদ্যুৎকে মানুষ আপন করায়ত্তে যেদিন নিয়ে এলো সেদিন মানব-ইতিহাসে এক বিরল অধ্যায়ের সূচনা ঘটল। সেই নতুন যুগের নামকরণ করা হলো আলোকের যুগ বা গতির যুগ। আর সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো মানবগোষ্ঠীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। চারদিকে গতি-ব্যস্ততার মহোল্লাস শুরু হয়ে গেল। আজ বিদ্যুৎ মানবজীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করেছে, প্রশস্ত করে দিয়েছে দূর-দূরান্তের অবাধ গতিবিধি। বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা, টেলিগ্রাফ-টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন সবই রহস্যময় বিদ্যুৎ-শক্তির বিস্ময়কর অবদান। ঘরের কোণে বসে আমরা আজ দূর দূরান্তের পৃথিবীকে সহজে প্রত্যক্ষ করতে পারছি। অনায়াসে তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছি।
এমনকী ব্যাধি-বিজয়ের কাজেও বিদ্যুৎ এসে নিঃসঙ্কোচে হাত লাগিয়েছে; রোগজর্জর মানুষকে দিচ্ছে আরোগ্যের ঠিকানা। বিদ্যুৎ আজ রাত্রির অন্ধকারকে আলোকিত করছে, তাপদগ্ধ গ্রীষ্মের নিদারুণ অস্বস্তির অবসান ঘটিয়ে ঘোরাচ্ছে পাখা, চালাচ্ছে এয়ারকুলার, বাসগৃহকে করেছে শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত। রন্ধনকার্যে ও কাপড় ধোয়ার কার্যেও এর সীমাহীন অবদান। তাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে রয়েছে বিদ্যুতের সক্রিয় স্পর্শ। বিদ্যুৎকে বাদ দিয়ে আধুনিক সুসভ্য জীবন একেবারেই অচল।
চিকিৎসা-বিজ্ঞানে বিদ্যুতের অবদান ঃ আজ মানুষের আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞানের যে বিস্ময়কর উন্নতি সাধিত হয়েছে তা সম্ভবপর হয়েছে বিদ্যুতের সাহায্যেই। দেহাভ্যন্তরে কোনো স্থান ব্যাধিগ্রস্ত হলে যখন কোনোকিছুতেই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না তখন অনুমান-নির্ভর চিকিৎসা না চালিয়ে এক্স-রে বা রঞ্জনরশ্মির সাহায্যে দেহাভ্যন্তরের ছবি তুলে রোগ নির্ধারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সঠিক চিকিৎসা করা সম্ভব হয়। অনুমান-নির্ভরতা থেকে বিদ্যুৎ চিকিৎসা-বিজ্ঞানকে মুক্তি দিয়েছে। এছাড়া, বৈদ্যুতিক-রশ্মির সাহায্যে ক্যান্সারের মতো নানা দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসাও করা হচ্ছে।
আরো পড়ুন ঃ
উৎপাদনে বিদ্যুতের অবদান ঃ বিদ্যুৎ আজ বিশ্বের ইতিহাসে চমক সৃষ্টি করেছে। সে আজ কলকারখানার উৎপাদনকে দ্রুততর করে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কেবল বৃহদায়তন শিল্পেই নয়, কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্রায়তন শিল্পগুলোতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফলে বিশাল বিশাল সব যন্ত্রদানব আজ বিদ্যুৎশক্তির বলে পরিণত হয়েছে মানুষের ক্রীতদাসে। বৈদ্যুতিক তথা ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ঢেলে সাজানো হচ্ছে সারা বিশ্বের উৎপাদন-ব্যবস্থাকে। বৃষ্টিহীন অঞ্চলে ও শুষ্ক মৌসুমে পানি সেচের সাহায্যে ধরিত্রী শস্যবতী হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, বর্তমান পৃথিবীতে উৎপাদন যে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎই বর্তমানকালের কৃষি ও শিল্পোৎপাদনে চালক-শক্তির ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এর ফলে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন বহু গুণে বেড়েছে।
পরিবহন ও যোগাযোগে অবদান ঃ পরিবহণ ও যানবাহনের ইতিহাসেও বিদ্যুতের অবদান অসীম। বিশ্বের আধুনিক শহরগুলোতে বিদ্যুতের সাহায্যে ট্রাম ও রেলগাড়ি চলছে। ইলেকট্রিক ট্রেন বাষ্পচালিত ট্রেনের চেয়ে দ্রুতগামী এবং এর সাহায্যে দূরবর্তী স্থানে স্বল্প সময়ের মধ্যে যাতায়াত করা যায়। আর শহরে সম্প্রতি যেসব গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মিত হচ্ছে, বিদ্যুৎ-চালিত 'লিফ্ট'ই তাতে ওঠা-নামার একমাত্র সহায়ক। বিদ্যুতের সাহায্যেই গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক বিমান ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প।
বিশালাকৃতি যেসব জাহাজ সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে, যেসব ডুবোজাহাজ সমুদ্রতলে বিচরণ করছে সেগুলো চলছে বিদ্যুৎশক্তিতে। এছাড়া, বন্দরে এবং রেল-স্টেশনে যে 'কপিকল' অতি ভারী সমস্ত মালামাল উত্তোলন করে ও নামিয়ে দেয়, তারও শক্তির উৎস হলো বিদ্যুৎ। অন্যদিকে, টেলিগ্রাম, টেলিফোন ও টেলিপ্রিন্ট, ফ্যাক্স, টেলেক্স, মোবাইল, ই-মেইল ইত্যাদি যে বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে দ্রুততর করে তুলেছে, তাও তো বিদ্যুতেরই অবদান ।
জ্বালানির পরিবর্তে পানিবিদ্যুৎ ঃ জ্বালানি পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিন অনেক আগেই শেষ হয়েছে। আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিকগণ বন্যা- নিয়ন্ত্রণের জন্য পৃথিবীর খরস্রোতা নদীগুলোকে বন্দি করতে গিয়ে পেলেন অফুরন্ত পানিবিদ্যুতের সন্ধান। পৃথিবীর উচ্ছৃঙ্খল নদীগুলোর অবাধ্য জলস্রোতে যে এত প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুতের সম্ভাবনা ছিল, তা আগে কেউ জানতো না। পানিবিদ্যুতের উৎস অফুরন্ত। কিন্তু পৃথিবীর জ্বালানি-সম্ভাবনা সীমিত।
কাজেই দুনিয়ার সব দেশেরই উচিত জ্বালানি সংরক্ষণ করে স্রোতস্বিনী নদীগুলো জলস্রোত থেকে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোনিবেশ করা। কারণ এ উৎপাদন সহজলভ্য ও সস্তা। বিশেষত, অনুন্নত দেশগুলো দুরন্ত নদীগুলোকে মজবুত কংক্রিটের বাঁধন এঁটে যদি পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তবে তারা যেমন উপকৃত হবে, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দুয়ারও উন্মোচিত হবে।
মহাকাশ অভিযানে বিদ্যুৎ ঃ মহাকাশ অভিযান ও মহাকাশ বিজয়ে মানুষের সমস্ত সাফল্যের মূলে বিদ্যুতের অবদান বিস্ময়কর। সূক্ষ্মাতিসূ ক্ষ্ম গণনা, নির্ভুল দিকস্থিতি নির্ণয়, পরিমিত তাপমাত্রা সংরক্ষণ এবং মহাকাশ অভিযানের হুবহু ছবি পৃথিবীতে প্রেরণ ইত্যাদির মতো অকল্পনীয় কাজ এখন বাস্তবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করছে বিদ্যুৎ। গ্রহে-উপগ্রহে বিভিন্ন নভোযান ও নভোখেয়া উৎক্ষেপণও চলছে বিদ্যুতের সাহায্যে । যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা (NASA) সম্পূর্ণভাবে ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক প্রযুক্তিনির্ভর।
আরো পড়ুন ঃ
বিদ্যুৎ ও বাংলাদেশ ঃ বাংলাদেশ এখনো বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিদ্যুৎ ঘাটতি আমাদের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। অত্যধিক জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক মেরুকরণ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা-পীড়িত বাংলাদেশে বিদ্যুতের ঘাটতি একটি বড় সমস্যা। এ ঘাটতি সমাধানে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিদ্যুৎঘাটতি অব্যাহত আছে এবং দিন দিন বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েই চলেছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ না করলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা যে পিছিয়ে পড়ব এতে কোনো সন্দেহ নেই ।
উপসংহার ঃ বর্তমানকালে বিদ্যুৎ আমাদের নিত্য-সহচর। বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা এক মুহূর্ত চলতে পারি না। আমাদের পরিশ্রমভার লাঘব করে দিচ্ছে, আমাদের বিশ্রাম-সুখকে পরিপূর্ণতা দান করছে। শুধু তাই নয়, আমাদের শহরগুলোকে আলোকমালায় সাজিয়ে তাদের অপরূপ করে তুলেছে। অপরদিকে, আমাদের সহস্র যুগের অন্ধকারময় গ্রামগুলোকে আলো জ্বালিয়ে উজ্জ্বল করে তুলছে। সকাল থেকে রাত্রি এবং রাত্রি থেকে সকাল- বিদ্যুৎ আমাদের সেবায় নিবেদিত। এককথায়, বিদ্যুৎ মানবজীবনে এক অপরিহার্য বিষয় যা মানব- সভ্যতার বিকাশে তার অসামান্য অবদান সত্যই অনস্বীকার্য।
সবগুলো রচনা একসাথে দেখতে এখানে চাপ দিন
ফিউচার ড্রীম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url