বাংলাদেশের কৃষক রচনা | বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা

বাংলাদেশের কৃষক রচনা

বাংলাদেশের কৃষক/বাংলার কৃষক

ভূমিকা ঃ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ আর কৃষকই বাংলাদেশের প্রাণ। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলাদেশের মাঠে-প্রান্তরে যে কৃষিদ্রব্য উৎপন্ন হয়, তার সাথে সমগ্র দেশবাসীর ভাগ্য জড়িত। এদেশের শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষই কৃষিজীবী। এদেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ কৃষির ওপর নির্ভরশীল বলে কৃষকের অবস্থার সাথে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার চালচিত্র নির্ভরশীল।

বাংলার কৃষক ঃ যে সব শ্রমনিষ্ঠ মেহনতি মানুষের রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে এদেশ অনুপম, পুষ্পময় ও মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে; রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শক্ত হাতে লাঙল ধরে, কৃপণা ধরণীর কঠিন মাটি চিরে নতুন ফসলের অযুত সম্ভাবনায় এদেশকে সমৃদ্ধ করেছে

তারা হলো এদেশের কৃষক সম্প্রদায় তথা বাংলার কৃষক। তারা দেশ ও জাতির অগ্রগতির স্বার্থে প্রতিদানহীন— নিঃস্বার্থ ভূমিকায় অবতীর্ণ। বিদ্রোহী কবি কাজী নরুল ইসলাম কৃষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন এভাবেই

আরো পড়ুন ঃ আমার পড়া একটি বইয়ের গল্প রচনা

'গাহি তাহাদের গান-

ধরণীয় হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান ।'

বাংলার কৃষক ও সোনালি অতীত ঃ একদা কৃষকই ছিল বাংলার অর্থনীতি মূল উৎপাদনশক্তি। তাদের জীবনও ছিল সুখময়। চতুর্দশ শতকে বাংলাদেশ সফরে এসে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন তা কৃষি ও কৃষির সোনালি অতীতকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন জনসংখ্যা ছিল কম, জমি ছিল পরিমাণে অনেক বেশি, ফলে কৃষকদের জীবনে সম্পদের প্রাচুর্যও ছিল অনেক বেশি। তারা তখন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করত। গোলা ভরা, ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা। গরু-গ্রামের সরল কৃষকদের চাহিদা পূরণে আর কি কিছুর প্রয়োজন ছিল?

আজকের কৃষক ঃ কৃষি ও কৃষকের সেই সোনালি দিন আজ তিরোহিত। ইংরেজদের আগমনে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে যে ভাঙন ধরেছিল তা থেকে পরবর্তীকালে কৃষক সমাজ মুক্তি লাভ করতে পারেনি। দেশের অন্নসংস্থানের মহান ব্রতে নিয়োজিত এই কৃষক আজ দুবেলা দুমুঠো ভাত পায় না। যান্ত্রিক সভ্যতার এ চরম উৎকর্ষের যুগের কৃষক পড়ে রয়েছে মান্ধাতার আমলের চাষাবাদ পদ্ধতির ব্যর্থ প্রচেষ্টর মাঝে।

এখনো সেই করুণ ছবি— একজোড়া শীর্ণ কঙ্কালসার বলদের পেছনের শীর্ণতার হাড্ডিসার কৃষক চেপে ধরে আছে প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তর যুগের সচেতনতা— এই দুয়ের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অজ্ঞতার অন্ধকার। বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষকদের শতকরা ৬০ ভাগ কৃষকই ভূমিহীন প্রান্তিক চাষি ।

কৃষকদের সমস্যার স্বরূপ ঃ বিজ্ঞান শাসিত পৃথিবীতে কৃষিক্ষেত্রেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কিন্তু দুর্ভাগ আমাদের যে, বাংলাদেশে কৃষিকর্ম এখানে মূলত মধ্যযুগীয়। এখনো দেশের অনেক অঞ্চলে সেই আদিকালের লাঙল, গৃহপালিত পশুর সাহায্যে জমি চাষ করা হয়। তাছাড়া, কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা এদেশে অপ্রতুল। এখনো কৃষকেরা বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু খেয়ালি প্রকৃতি অধিকাংশ সময়ই তাদের প্রত্যাশা পূরণের কার্পণ্য প্রদর্শণ করে ।

প্রতিবছরই অতিবৃষ্টি অথবা নদীবাহিত জলধারায় এদেশের প্রচুর ফসল নষ্ট হয়। কৃষি উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে প্রধান হলো ধান। এরপর হলো পাট ও আখ। আখের ক্ষেত্রে কিছুটা ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলেও এক কালের সোনালি আঁশ এখন এদেশের কৃষকেরা গলার ফাঁস। কৃষকরা ভরা মৌসুমী কৃষিপণ্যের মূল্য পায় না। তাদের উৎপাদন ব্যয় ওঠে না। ফলে প্রতিবছর লোকসান গুণতে গুণতে অনেক কৃষক হয়ে পড়ে নিঃস্ব, রিক্ত।

কৃষকদের দুরবস্থার কারণ ঃ

  • ১. ঔপনিবেশিক শাসনের বিষফল হিসেবে সৃষ্ট চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথায় কৃষকদের করা হয়েছিল ভূমিদাস। সেই দীর্ঘ শোষণ-বঞ্ছনায় কৃষকদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড যে ভেঙে গিয়েছিল তা আর সোজা হয়নি।
  • ২. দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা গতানুগতিক ও বৈষম্যপূর্ণ। ফলে ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিদের কৃষি-শ্রমিক ছাড়া কিছুই বলা যায় না।

আরো পড়ুন ঃ আমার জীবনের লক্ষ্য রচনা

  • ৩. কৃষকদের সহজ শর্ত ও দ্রুত ঋণ প্রাপ্তির বিষয়টি কখনোই স্বচ্ছ হয়নি। পুঁজি স্বল্পতায় কৃষকরা মহাজন, দাদন ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন এনিজও-র শোষণের শিকার হচ্ছে।
  • ৪. কৃষিকে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হয়নি। ফলে আমাদের কৃষক মধ্যযুগেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের উৎপাদন কম। ফলে অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটছে না।
  • ৫. আমাদের ভূমি খণ্ডিত। এ ভূমিতে যান্ত্রিক চাষাবাদ ব্যাহত হয়।

কৃষকের উন্নয়নে করণীয় ঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আজ পুনরুজ্জীবিত করতে হলে সর্বাগ্রে চাই কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব। আর এ জন্য প্রথমেই কৃষিকাজের মহানায়ক কৃষকের জীবন এবং তার দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে হবে। সমস্ত উন্নত দেশেই আজ কৃষিকাজের পদ্ধতি, উপকরণ ও তার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। কাজেই দেশের উন্নয়নে এবং কৃষকের ভাগ্যের উন্নয়নে আমাদের অপরিহার্যভাবেই কৃষিক্ষেত্রে যন্ত্র প্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে হবে। কাঠের লাঙলকে বিদায় জানাতে হবে। তাদের হাতে বিজ্ঞানের হাতিয়ার তুলে দিতে হবে। সেই সাথে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। শিক্ষার মাধ্যমেই কৃষক তার শতাব্দী ব্যাপী অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধর্মীয় পশ্চাৎপদতা ঘুচিয়ে একজন বিজ্ঞানমনস্ক সুস্থ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কৃষি কর্মকর্তাদের সক্রিয় সহযোগিতায় কৃষক সম্প্রদায়কে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। বন্যার পানি যেন ফসলের ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ কিংবা নদী খননের মাধ্যম বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিঋণকে অবারিত ও সহজ শর্তযুক্ত করতে হবে।

উপসংহার ঃ কৃষকরাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির মেরুদণ্ড, বাংলাদেশের প্রাণস্বরূপ। সেই প্রাণ ছিল এতকাল অনাদৃত। ছিল উপেক্ষিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এদের ওপর চলেছে নির্বিচার অত্যাচার। মনুষ্যত্ব হয়েছে নিগৃহীত। এ অবস্থার অবসান কামনা করছি আমরা।

সবগুলো রচনা একসাথে দেখতে এখানে চাপ দিন

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
2 জন কমেন্ট করেছেন ইতোমধ্যে
  • Anonymous
    Anonymous April 27, 2024 at 12:53 PM

    অনেক সুন্দর একটা রচনা

    • Munna Dey
      Munna Dey April 30, 2024 at 8:32 PM

      ধন্যবাদ 💙💙

মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ফিউচার ড্রীম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url