একটি সড়কের আত্মকাহিনি রচনা | বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা

একটি সড়কের আত্মকাহিনি রচনা

একটি সড়কের আত্মকাহিনি

আমার চারপাশে কোলাহলময় ও যানবাহন-মুখরিত ব্যস্ত ঢাকা শহর। তারই মাঝখানে একেবারে নীরব ও শাস্ত সড়ক আমি। আমার বুকে পড়েছে দুপাশের দীঘল পলাশ, গাছের ছায়া। তোমরা অনেকেই হয়তো আমাতে চিনতে পারবে না। কিন্তু আমার ঠিকানা তোমাদের সবা জানা। তোমাদের গাছপালাহীন যান্ত্রিক শহরের ঠিক কেন্দ্রে শ্যামল-সুবজে ঘেরা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাই আমার ঠিাকানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে পুরোনো সড়কের তালিকায় রয়েছে আমার নাম। আমার নাম ফুলার রোড।

১৯২০-এর দশকে গড়ে উঠেছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন থেকে কত মেধাবী শিক্ষক, কত বরেণ্য বুদ্ধিজীবী হেঁটে গেছেন আমার বুকের ওপর দিয়ে। আমি গভীরে এখনো তাঁদের গভীর চিন্তামগ্ন যাত্রার পদধ্বনি শুনতে পাই। এখনো মেধাবী শিক্ষকরা আমার বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান পাঠদান করতে, যান সেমিনারে, যান আলোচনা সভায় বক্তব্য দিতে। আমি তাদের পদধ্বনির সঙ্গে সেকালের শিক্ষকদের পদধ্বনির যোগসূত্র খুঁজে পাই। আমার খুব ভালো লাগে।

আরো পড়ুন ঃ একটি বইয়ের আত্মকাহিনি রচনা

মাঝে মাঝে গর্ব অনুভব করি এই ভেবে যে, আমার বুকের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা কত না তত্ত্বের কথা ভেবেছেন, সৃজনশীল কাজের খসড়া মনে মনে গেঁথে তুলেছেন। আমার কাছে এ এক বড় পাওয়া, অসাধারণ পাওয়া । মাঝে মাঝে গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন দূর থেকে ভারী কোনো ট্রাক বা লরির শব্দ ভেসে আসে। আমি চমকে শিউরে উঠি, ডুবে যাই দুঃসময়ের ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে। আমি দেখতে পাই, আমার বুকের ওপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভারী সামরিক যান। 

আমি শুনতে পাই অসংখ্য বুটের শব্দ। আমার চোখে ভাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তাণ্ডব। তারা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসে শিক্ষকদের বাসায় বাসায় কড়া নাড়ছে। তাদের টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনছে। আমি তাদের আতঙ্কিত পরিবার-পরিজনের কান্না শুনতে পাই। শুনতে পাই হুইসেলের শব্দ, গুলির শব্দ। আমি শিউরে উঠি। হয়তো কাউকে মেরে ফেলা হলো। হয়তো কাউকে টেনে-হিঁচড়ে তোলা হলো সামরিক যানে। আমি জেগে উঠি। বুঝতে পারি একাত্তরের ভয়াবহ সে দিনগুলো এখনো দুঃস্বপ্নের মতো আমাকে তাড়া করে।

আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তোমার শহিদ দিবসকে। তোমরা কী শান্ত, শোকস্মৃতিতে আনত পদক্ষেপে হেঁটে যাও আমার বুকের ওপর দিয়ে শহিদ মিনারের দিকে। তোমাদের কারো হাতে ফুল, কারো হাতে ফুলের স্তবক, তোমাদের কণ্ঠে একুশে ফেব্রুয়ারি গান। আমি তোমাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই। কারণ আমি নিজেই তো একুশের ঘটনার সাক্ষী। আমার ভালো লাগে তোমরা যে শহিদদের স্মরণ করে তাদের শ্রদ্ধা জানাও । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আমাকে খুব ভালোবাসে। তারা বলে, আমি নাকি এই এলাকার সবচেয়ে সুন্দর সড়ক। যানজটের এই ঢাকা শহরে এখানেই নাকি কোনো যানজট নেই।

রোজ বিকেলে আমার চারপাশে ছাত্রছাত্রীরা ঘোরাঘুরি করে, তারা দলে দলে গল্প করে, আড্ডা জমায়, গান গায় গুনগুন করে। কেউ নিজের কথা বলে, কেউ ভবিষ্যতের কথা ভাবে, কেউ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করে। আমি চুপ করে তাদের কথা শুনি । সারা দেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী আসে এখাতে পড়তে। পড়া শেষ হলে পুরোনোরা চলে যায়। ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আমি তাদের সবার কথাবর্তা, কাজকর্ম, ভাবনা-চিন্তর সাক্ষী হয়ে এখানে পড়ে থাকি। মাঝে মাঝে মনে মনে ভাবি, এদের মধ্যে কেউ কেউ

হয়তো আবার এখানে আসবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে। সে আবার শান্ত পায়ে আমার ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে। অন্যদের কেউ হয়তো হবে রাজনীতিবিদ, কেউ চাকরি করবে, কেউ বিদেশ পাড়ি জমাবে। মনে হয়, আমার স্মৃতিও তাদের মনে থাকবে। নানা ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝে মাঝে হয়তো মনে পড়বে আমার কথা। কেউ হয়তো স্মৃতির টানে এই বিশ্ববিদ্যালয় খেতে চলে আসবে। আমি প্রতিদিন তাদের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকি। যারা দূরে চলে যায় তাদের কেউ কেউ সত্যিই এখানে এসে হাজির হয়। যারা কাছে থাকে তাদের অনেকের কথা আর মনে পড়ে না কাজের চাপে। তারা ভুলে যায় তাদের সোনালি দিনগুলোর কথা।

আরো পড়ুন ঃ একটি বটগাছের আত্মকথা প্রবন্ধ রচনা

এতে কিন্তু আমার কষ্ট হয় না। কারণ প্রতিবছরই নতুন নতুন ছাত্রছাত্রী আসে। তাদের সে কী প্রাণচাঞ্চল্য, সে কী উদ্দীপনা। আমি প্রাণভরে তাদের পদধ্বনি শুনি। মন দিয়ে তাদের কথা শুনি। তাদের মধ্যে একধরনের পরিবর্তন আমি লক্ষ করি। আমি সে পরিবর্তন বুঝতে চেষ্টা করি। বুঝতে পারি, শিক্ষার আদর্শ বদলে যাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ। আর তার শিকার ও বাহন হচ্ছে নতুনরা।

তবু আমার ভাবতে ভালো লাগে, আমি এমন একটি জায়গায় বসেছি যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক সংগ্রামের অনেক ত্যাগের ইতিহাস। সে ইতিহাসের মাইল ফলক ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, এগারো দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ। আমি যে এসবের প্রত্যক্ষ সাক্ষী তা ভাবতে খুবই ভালো লাগে।

আমি এক সুখী সড়ক। কারণ আমি পেয়েছি এদেশের সেরা শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শ। আর এদেশের সেরা মানুষগুলো গড়ে তোলার কাজে পরোদ্ধ হলেও কিছু ভূমিকা আমি রাখতে পারছি। সড়ক হিসেবে আমার এ জীবন সত্যিই ধন্য ।

সবগুলো রচনা একসাথে দেখতে এখানে চাপ দিন

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ফিউচার ড্রীম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url