একটি কলমের আত্মকথা রচনা | বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা

একটি কলমের আত্মকথা রচনা

একটি কলমের আত্মকাহিনি

আমি ঝরনা কলম। ফাউন্টেন পেন। কবে কোথায় আমার জন্ম জানি না। কখন থেকে এ বাসায় আছি তাও মনে নেই। আসলে, সন- তারিখের হিসাব কেবল মানুষেই রাখে। তাদের হয়ে সেসব টুকে রাখা আমার কাজ। নিজের হিসেবে রাখার ক্ষমতা কই আমার!

আমি এই বাড়ির কর্তার দীর্ঘ দিনের প্রিয় সঙ্গী। তিনি আমাকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে। আমার গায়ে আঁকা সবুজ পাহাড় উড়ন্ত ঈগল তাঁর খুব মনে ধরেছিল। এ নিয়ে কথা উঠলেই সবাইকে তিনি বলতেন : 'আমার কলমের এই ছবিটার একটা মানে আছে। এই পাহাড়টা হলো অলিম্পাস পর্বতের চূড়া। প্রমিথিউস এখানে বন্দি হয়ে আছে আগুন চুরির দায়ে। আর ঈগলটা উড়ে আসছে তাকে ঠুকরে ঠুকরে শাস্তি দিতে।'

▶▶ আরো পড়ুন ঃ একটি সড়কের আত্মকাহিনি বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা

আমার বন্ধুটি আসলে কল্পনাবিলাসী এক টগবগে যুবক। আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় প্রতিবাদী। তাঁর অভ্যাস ডায়রি লেখা। তাঁর ডায়রির পাতায় পাতায় কত আবেগ আর অনুভূতি আমি ফুটিয়ে তুলেছি কালির আঁচড়ে। তার অবসর কাটত লেখালেখিতে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি প্রতিবাদী লেখা ছাপাতেন পত্রিকায়। রাতের পর রাত জেগে লেখা তাঁর সব লেখার সাথী হয়ে আছি আমি। আমাকে দিয়ে লেখা সেসব পাণ্ডুলিপি ঠিকমতো রাখা হয়নি। তবে সেগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পত্রিকার পাতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিনে ।

লেখার সময় কাটাকাটি করা ছিল তাঁর অভ্যাস। পছন্দ না হলে নতুন করে আবার লেখা শুরু করতেন। কখনো হয়তো কালি শেষ হয়ে যেত। তাড়াতাড়ি কালি ভরে তিনি আবার লেখায় বিভোর হয়ে যেতেন। পত্রিকায় পাঠানোর আগে আবার সুন্দর করে সব লিখতেন যেন ছাপায় ভুল না হয় । আমি কেবল তার লেখালেখির একমাত্র সাথী ছিলাম না, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোতেও ছিলাম তার প্রিয় সহায়।

একসময় আমার বন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ হলো। সাহিত্যের জগতে তিনি তখন উদীয়মান তারকা। নিজের যোগ্যতায় খুব ভালো একটা চাকরিও পেলেন তিনি। চাকরি জীবনে অনেক কলম তিনি উপহার পেয়েছেন। কিন্তু আমাকে তিনি মোটেও ভোলেননি । একথা ঠিক যে অফিসের কাজে তিনি আমাকে ব্যবহার করতেন না। কিন্তু রাত জেগে লেখালেখির কাজে আমিই ছিলাম তাঁর অপরিহার্য সঙ্গী।

এভাবে সময় বেশ ভালোই যাচ্ছিল। একসময় একটা উপন্যাস লেখায় হাত দিলেন। তখন শুরু হলো আমার ব্যস্ততায় ভরা চঞ্চল দিন। পাতার পর পাতায় এগিয়ে চলল কাহিনি। হঠাৎ কী মনে হলো- কয়েকদিন ধরে লেখা কাহিনি একেবারে বাদ গেল। আবার নতুন করে অন্যভাবে লেখা হলো কাহিনি। এভাবে পুরো একটা মাস ধরে আমরা উপন্যাস লেখার কাজে মগ্ন ছিলাম। আমার বন্ধুর তখন একটাই লক্ষ্য- এমন অভিনব কিছু লিখতে হবে যা এর আগে কেউ লেখেনি ।

আমরা সফল হয়েছিলাম। প্রথম উপন্যাসই পাঠক মহলে সাড়া তুলল। তাতে আমারও আনন্দ হলো। কারণ আমার নিব দিয়েই লেখা হয়েছিল ঐ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি । নিব দিয়েই লেখা এ পর আমার বন্ধু বিয়ে করলেন। ভেবেছিলাম লেখালেখি বন্ধ হয়ে যাবে। আমার আর গুরুত্ব থাকবে না। কিন্তু হলো তার উল্টো। বন্ধুর নতুন সুখী জীবন নতুন প্রেরণা হয়ে দেখা দিল। আবার শুরু হলো আমার ব্যস্ত সময়।

▶▶ আরো পড়ুন ঃ একটি বইয়ের আত্মকাহিনি বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা

একের পর এক লেখা লিখতে হচ্ছে। রাতের পর রাত জাগতে হচ্ছে। সে এক অন্যরকমের আনন্দ, অন্যরকমের শিহরণ। একদিন হঠাৎ করে আমার জীবনে নেমে এলো দুঃসময়। আর তা ঘটল আমার বন্ধুর পুত্রের দু বছর বয়সের পর। প্রতীক তখন বুঝতে শিখেছে। তার তখন কৌতূহলের শেষ নেই। চারপাশে যা দেখে তাতেই তার প্রবল আকর্ষণ । একদিন প্রতীকের কৌতূহলের শিকার হলাম আমি। বাবা-মার অগোচরে আমাকে নিয়ে সে খেলতে শুরু করল। হঠাৎ সে আমাকে হারিয়ে ফেলল বিছানার এক কোণে ।

অন্ধকার সেই কোণে পড়ে থেকে আমি সব শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার বন্ধু কয়েকদিন খুব খোঁজাখুঁজি করল। কিন্তু আমি যে এই অন্ধকার কোণে আটকে আছি তা জানানো গেল না কিছুতেই। কারণ আমার কাছে কেবল অন্যের হয়ে লেখার ভাষা, নিজের মতো করে বলার ভাষা তো আমার নেই। সেই থেকে প্রায় তিন তিনটে বছর আমি অন্ধকারের জগতে একলা পড়ে রইলাম। মুক্তি পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতীকই একদিন আমাকে খুঁজে পেল।

আমার বন্ধু আমাকে হাতে পেয়ে অনেকক্ষণ কী যেন ভাবলেন। মনে হয় তিনি স্মৃতির রাজ্যে ডুবে গিয়েছিলেন। আমি তখন আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছিলাম। আমি কি আর আগের মতো সমাদর পাব? আমার অন্যান্য বন্ধু ফাউন্টেন পেনরা অনেক আগেই বাতিলের ঘরে ঠাঁই পেয়েছিল। যুগ পাল্টে গেছে। এসেছে বল পেন আর জেল পেনের যুগ। জানি না আমার ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে!

▶▶ আরো পড়ুন ঃ একটি বটগাছের আত্মকথা বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা

আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার বন্ধু তার পুত্রের হাতে আমাকে তুলে দিলেন। বললেন, 'প্রতীক, আমার প্রিয় কলমটা তোমাকে দিলাম। এবার তোমার লেখার পালা।' পাঁচ বছর বয়সী প্রতীক তার বাবার কথা বুঝতে পারেনি। কিন্তু আমি পেরেছিলাম। তাই সে যখন তার ছোট ছোট আঙুলে প্রাণপণে আমাকে দিয়ে লেখার চেষ্টা করে, কালি ছড়ায়, কাটাকুটি করে আমি বিরক্ত হই না। তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে। হয়তো এই আশায় যে, তার বাবার মতো তার প্রথম লেখাটিও একদিন আমিই লিখব ।

সবগুলো রচনা একসাথে দেখতে এখানে চাপ দিন

সবগুলো ভাবসম্প্রসারণ একসাথে দেখতে এখানে চাপ দিন

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ফিউচার ড্রীম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url