একটি গ্রামে একদিন রচনা | বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা

একটি গ্রামে একদিন রচনা

একটি গ্রামে একদিন

বাংলার গ্রামগুলো প্রকৃতির আদরের সন্তান। প্রকৃতি তার অপরূপ সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য দিয়ে গ্রামগুলোকে সবুজ-শ্যামল করে সাজিয়ে তুলেছে। গ্রামে বেড়াতে গিয়ে আমি বুঝেছি গ্রামের সঙ্গে পরিচয় না হলে বাংলাদেশকে পুরোপুরি জানা হয় না। আসলে গ্রাম ছাড়া বাংলাদেশের পূর্ণতা নেই। গ্রামের শান্ত পরিবেশ, সরলতা ও সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি আমাকে আকর্ষণ করে। সেই আকর্ষণের টানেই আমি গ্রামে যাই; কেবল একদিনের জন্য হলেও যাই। এমনি একদিনের জন্য গ্রামে গিয়েছিলাম আমি গত এপ্রিল মাসের নয় তারিখে। সেদিন গ্রামে যাওয়ার ঘটনা আমার মনে ছবির মতো জ্বলজ্বল করছে।

উপলক্ষটি ছিল আমার নানুর মৃত্যুবার্ষিকী। ভাড়া করা মাইক্রোবাস যথাসময়ে আমাদের বাসার সামনে এসে থামল। সকাল সাতটার দিকে আমরা রওয়ানা দিলাম। আবহাওয়া বেশ ভালো ছিল। মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে কাছের-দূরের ছবি চলচ্চিত্রের মতো ভাসছিল চোখে । একসময় শহরের ছবি হারিয়ে যেতে লাগল। গাছপালা, ধানক্ষেত, গ্রামের ছবি ধরা পড়ল দৃষ্টিতে। চৌদ্দগ্রামে যাত্রাবিরতিতে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে কিছু খেয়ে নিলাম। যাত্রাবিরতির পর বাস আবার ছুটতে শুরু করল। পথের দু পাশের সারি সারি গাছ মাথার ওপর যেন সবুজ চাদর তৈরি করেছে, যেন আমরা একটা সবুজ গুহার মধ্য দিয়ে ছুটে যাচ্ছি।

আরো পড়ুন ঃ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা

সকাল ১১টার দিকে আমরা গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলাম। মামা-মামি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমাকে মামি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা ভেতরে গেলাম। সেখানে মজা করে শরবত আর মুড়ি-বাতাসা খেলাম। আমার মামাতো ভাইয়েরা সেখানে ছিল। প্রথমে আমরা নানির কবর জিয়ারত করলাম। এরপর মামাতো ভাইদের সাথে বের হলাম গ্রাম ঘুরে দেখতে। আমাদের বাড়িতে দুটো পুকুর। সামনের পুকুরটা বেশ বড়। তাতে রুই, কাতল প্রভৃতি মাছের চাষ হচ্ছে। নানুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সেটাতে টানা জাল ফেলে মাছ ধরা হচ্ছিল। আমরা সেখানে গিয়ে মাছ ধরা দেখতে লাগলাম। জালে নানা জাতের অনেক মাছ উঠল। কিন্তু কেবল বড় রুইগুলো রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দেওয়া হলো। মাছ ধরা শেষে আমরা বেশ কিছু ডাব পেড়ে ডাবের পানি খেলাম।

কিছু কাঁচা আমও পাড়া হলো । এরপর আমরা বের হলাম গ্রাম দেখতে। বাড়ির বাইরে আসতেই চোখে পড়ল বিস্তীর্ণ খোলা ধানক্ষেত। ক্ষেতে চাষিরা ধান গাছের চারা রোপণ করছে। পথের দু পাশে নানারকম গাছ। গাছে গাছে শোনা গেল পাখির কলকাকলি। একটা হলদে পাখি দেখলাম। গাছের ডাল থেকে ডালে হলুদ এক ঝলক আলোর মতো লাফিয়ে চলছে সেটি। একটা তালগাছের ডালে বাবুই পাখির বাসা ঝুলতে দেখলাম। মাঠের ঘাসের মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে ফিঙে পাখি। একঝাঁক চড়ুই পাখি উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। একটা কাঠঠোকরাকেও দেখলাম গাছে ঠক্‌- ঠক্ করে ঠোঁট দিয়ে গর্ত করতে। মাঠে গরু-ছাগল চরে বেড়াচ্ছে অলসভাবে। রাস্তার অপর পাশেই সরিষার ক্ষেত। হলুদ সরিষার ক্ষেতে বাতাস বয়ে যাচ্ছে, সে দৃশ্য যে দেখেছে সেই অভিভূত হবে।

এভাবে প্রকৃতিকে দেখতে দেখতে আমরা গ্রামের রাস্তায় চললাম। একে একে ডাকঘর, মসজিদ, স্কুলঘর, চণ্ডিমণ্ডপ, জেলেপাড়া, কুমোরপাড়া ফেলে আমরা চলে এলাম গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে। এখানে রয়েছে পুরোনো দিনের একটা জমিদার বাড়ি। বিশাল সে বাড়ি। বাড়িটা পোড়ো বাড়ি। কেউ এখানে থাকে না। অনেক জায়গায় ভগ্নদশা। সামনে রয়েছে এক বিশাল দিঘি। লোকজন দিঘির পানিতে গোসল করছে, সাঁতার কাটছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দিঘি থেকে শাপলা তুলছে। কেউবা বড়শি ফেলে মাছ ধরছে। মাঝে মধ্যে দু- একজন দিঘির একপাড় থেকে অন্যপাড়ে সাঁতরে চলে যাচ্ছে। একটু পরেই একটা টোড়া সাপকে দেখলাম পানি চিরে এগিয়ে যেতে। আর একটা গুঁইসাপকে দেখলাম গুটিগুটি পায়ে পানিতে নামতে। 

কিছু ছেলে দিঘির পাড়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছিল। সেই সাদা সাদা ঘুড়িগুলোর সাথে পাল্লা দিতেই যেন একঝাঁক পায়রা উড়ছিল। দেখলাম, হঠাৎ করে এক মাছরাঙাকে ছোঁ মেরে মাছ ধরে উড়ে যেতে আর উড়ন্ত অবস্থাতেই অদ্ভূত কায়দায় সেই মাছ গিলে খেতে। তাদের রং-বেরঙের পালক আর মাছ ধরার কৌশল এককথায় অপূর্ব। তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতেই যেন উড়ে এসেছে কিছু বক। দেখলাম, দিঘির জংলা দিকটার পাড়ে জলের কাছে ধবধবে সাদা বকগুলো অসীম ধৈর্যের সাথে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে মাছ ধরতে। আর একদল হাঁস প্যাক প্যাক করে দিঘির পানিতে চড়ে বেড়াচ্ছে। কিছু রাজহাঁসও দেখলাম। তাদের শুভ্র ও লম্বা গলা ও রাজকীয় ভঙ্গি দেখে মনে হলো যেন এগিয়ে চলেছে কোনো বজরা।

আরো পড়ুন ঃ ছুটির দিনে বনভোজন রচনা

প্রকৃতির এই অনাবিল সৌন্দর্য যখন উপভোগ করছিলাম, তখন হঠাৎ করেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। গ্রীষ্মের সেই প্রখর খরতাপের মাঝে এই হঠাৎ বৃষ্টি যেন প্রকৃতির আনন্দাশ্রু। তাড়াতাড়ি পুরোনো দালানের পাশে একটা চালার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। অন্যরা আনন্দে ভিজতে লাগল। যে ছেলেরা মাঠে ঘুড়ি উড়াচ্ছিল তারা তখন ফুটবল খেলা শুরু করে দিল। বৃষ্টিতে মাঠ কর্দমাক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই প্যাচপেচে কাদার মধ্যে তারা পিছলে পড়ছিল, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছিল। মনে হলো, শহরের বাঁধাধরা জীবনে মুক্ত জীবনের এই আনন্দটুকু কখনোই আমরা পাই না।

বৃষ্টি একটু থামতেই আমরা বাড়িতে ফিরে এলাম। নানুর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন সবাই এসেছেন। তাদের সঙ্গে আমাদের কুশল বিনিময় হলো। আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে খেলাম। ভাতের সাথে ডাল, মাছ ও মাংস। শহরে মাছ আমি একদমই খেতে পারি না। কিন্তু এখানে এসে নিজেদের পুকুরের মাছে যেন অমৃতের স্বাদ পেলাম।

বিকেল হয়ে আসছিল। আমাদের ফেরার সময় হয়ে এলো। এবার বিদায় নেওয়ার পালা। মামা-মামির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সেই গ্রামের ফিরতি পথে রওয়ানা দিলাম। রাত ৮ টার দিকে আমরা ঢাকায় ফিরলাম।

সেদিনের সেই গ্রামের ভ্রমণ আমার সবচেয়ে সীমিত সময়ের গ্রামের যাত্রা। কিন্তু সেই যাত্রা আমার স্মৃতিতে বহুদিন অটুট থাকবে।

সবগুলো রচনা একসাথে দেখতে এখানে চাপ দিন

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ফিউচার ড্রীম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url