বই পড়ার আনন্দ প্রবন্ধ রচনা | বাংলা ২য় পত্র প্রবন্ধ রচনা
বই পড়ার আনন্দ
ভূমিকা ঃ মানুষ সব সময় মানুষের সঙ্গ কামনা করে। একটি প্রাণ চায় আর একটি প্রাণের সাড়া, একটি ভাব চায় আরেকটি ভাবের সাথে বিধৃত হতে। সমষ্টি জীবনকে বাদ দিয়ে কোনো মানুষের ব্যক্তিজীবনের পরিপূর্ণ স্ফুরণ হতে পারে না। আর সে জন্যই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষকে আমরা দেখি যৌথ জীবনের পটভূমিকায়। পারস্পরিক সাহচর্য মানব সভ্যতাকে দিয়েছে একটি বিশিষ্ট রূপ। এই সাহচর্য মানুষ আরেকভাবে পেতে পারে। এই মাধ্যমটি হলো বই।
বইয়ের আবির্ভাব ঃ সভ্যতার বিকাশের এক পর্যায়ে মানুষ তার হৃদয়ের ভাবকে, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে অন্য মানুষের, ভবিষ্যৎ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গ্রন্থ রচনার আশ্রয় নিল। আর ছাপাখানার আবিষ্কার বইয়ের প্রচারের সম্ভাবনাকে দান করল অজস্রতা। বইয়ের মাধ্যমে অতীত-বর্তমান, দূর-দূরান্তর আর দেশ-কালের গণ্ডির দুস্তর ব্যবধান দূর হয়ে গেল। নিজের ঘরে বসেই মানুষ পেতে শুরু করলো তাঁর আত্মার আত্মীয়কে। এ যেন বিশ্বমানবের সাহচর্য পাওয়া।
আরো পড়ুন ঃ আমার প্রিয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য রচনা
বইয়ের প্রয়োজনীয়তা ঃ বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তলস্তোয় বলেছেন, জীবনে তিনটি বস্তুই বিশেষভাবে প্রয়োজন, তা হচ্ছে বই, বই এবং বই। সমস্ত প্রাণিজগের সাথে মানুষের পার্থক্য এইখানে যে, মানুষ তার জ্ঞানকে, বোধকে অক্ষরের ভাষায় লিপিবদ্ধ করে বইয়ের মাধ্যমে যুগ- যুগান্তরের মানুষের জ্ঞান ও আনন্দলাভের জন্য রেখে যেতে পারে। বিশ্বের মহামূল্য গ্রন্থগুলো মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য সাধনার নির্বাক সাক্ষী । এগুলোর মধ্য দিয়েই মানুষ লাভ করেছে তার আপন অন্তরতম সত্তার পরিচয়। বই নানাভাবে মানুষের প্রয়োজন মেটায় ।
মানুষের কৌতূহল মেটায় বই ঃ বৈচিত্র্যময় এ পৃথিবীর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে বিস্ময়। অজানা, অবারিত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে চকিতে ধারণা দিতে পারে বই। বইয়ের মাধ্যমে মানুষ মুহূর্তে ছুটে যেতে পারে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তাই তো কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন---
“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি ।
বিশাল বিশ্বের আয়োজন
মোর মন জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এককোণ,
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আছে যাহে অক্ষয় উৎসাহে-"
নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে বই ঃ নির্জন অরণ্যে একাকী মানুষের নিঃসঙ্গতা মুছে দিতে পারে বই। জনহীন দ্বীপে নির্বাসিত জনের চিত্তে নিঃসঙ্গতার বেদনা দূর হয়ে যেতে পারে যদি তার কাছে থাকে কিছু বই। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিভূতিভূষণ, শেক্সপিয়র, গোটে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, দস্তয়ভস্কি কিংবা গোর্কির লেখা বই যদি সাথে থাকে তবে মানুষের হৃদয় মনের অনেক অভাব ঘুচে যায়।
আরো পড়ুন ঃ একটি গ্রামে একদিন রচনা
বই থেকে পাওয়া যায় অনাবিল আনন্দ ঃ নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ কখনও কখনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, হতাশার চোরাবালিতে ডুবে যায় ৷ এই চোরাবালি থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে পারে একটি ভালো বই। উৎকষ্ট বই মানুষকে দেয় অনাবিল আনন্দ। মানুষের উচ্চতর বৃত্তিগুলো চায় সত্য, জ্ঞান ও আনন্দের আলো। জ্ঞান-সাধনা ও শিল্প-সাধনা মানুষকে প্রতিদিনের তুচ্ছতার সংসার থেকে তুলে নেয় এক উচ্চতর ভাবালোকে । প্রতিদিনের কর্মক্লান্ত দিনের ব্যস্ততা, হানাদানি ও সমস্যাক্লিষ্ট জীবনের কর্কশতার মধ্যে বই মনকে দেয় অনাবিল আনন্দ। সেই সাথে করে জ্ঞানের বিস্তার। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, সংসারের জ্বালা যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে মনের ভেতর আপন ভুবন সৃষ্টি করা এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেওয়া।
যে যত বেশি ভুবন তৈরি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার তত বেশি হয়। দুঃখ-বেদনার মুহূ র্তে, মানসিক অশান্তিতে ও দুর্বলতার সময়ে বই মানুষের মনে শান্তি ও প্রেরণা জোগায়, দেয় নব নব প্রেরণা, উৎসাহ ও মানসিক প্রশান্তি।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায় বই ঃ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতু রচনা করে যুগোত্তীর্ণ গ্রন্থরাজি। গ্রন্থের সাহচর্যেই মানুষ অগ্রসর হয়ে চলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রম-অগ্রযাত্রার পথে । আমাদের বৃহত্তর জীবনের যাত্রাপথের সবচেয়ে বড় সঙ্গী বরণ্যে মনীষীদের লেখা মূল্যবান বই ।
মানুষের হৃদয়ানন্দে সৃষ্টি হয়েছে শিল্পকলা ও সাহিত্য আর প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। আর পরাজ্ঞান ও জগৎ রহস্যের উৎস সন্ধানে আমরা পেয়েছি প্রাচী ও প্রতীচীর দর্শনকে। কিন্তু আজকের দিনে আমরা কোথায় পাব হোমার, ভার্জিল, দান্তে, গ্যেটে, শেক্সপিয়র, দস্তয়ভস্কি আর রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ? কোথায় পাব মাদাম কুরি, মার্কনি, এডিসন, জগদীশ বসুকে? আজকের এই বিংশ শতাব্দীতে শংকর, প্ল্যাটো, এরিস্টটল আর কার্ল মার্কসকে প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু যদি থাকে একটা গ্রন্থাগার, তার বইয়ের মধ্যে পাওয়া যাবে এদের নিকট-সান্নিধ্য। অনুভব করা যাবে এদের নিঃশব্দ উপস্থিতি। কেবল বইয়ের মাধ্যমেই এই সব মনীষীর চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হয়ে জ্ঞান, আনন্দ ও পরিতৃপ্তি পাওয়া যেতে পারে।
আরো পড়ুন ঃ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা
মানুষকে উদার করে বই ঃ মানব হৃদয়ের বিচিত্র অভিব্যক্তি ও ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করা যায় বই পড়ার মাধ্যমে। ত্যাগের কাহিনি, বীরত্বের মহিমা, সত্যের জন্য আত্মদান, নানা দেশের ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বৃত্তান্ত, সামাজিক আচার-আচরণ, বিজ্ঞানের বিস্ময় বিস্ময়কর আবিষ্কার, দুঃসাহসিক অভিযান ও ভ্রমণ বৃত্তান্ত মানুষকে উদার হতে শেখায়। মনের দিগন্ত হয় উন্মোচিত ও প্রসারিত। ভালো বই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনকে শুদ্ধ করে, মানুষ খুঁজে পায় যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার ঠিকানা। মনের জানালা খুলে যায়, উঁকি দেয় মুক্ত চিন্তা। গ্রন্থরাজির মধ্যে এসে মেশে বিভিন্ন জাতির বিচিত্র জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যের বহুমুখী স্রোতধারা। 'আর সেই ধারায় অবগাহন করেই অর্জিত যে মানুষের চিৎপ্রকর্ষ। মনীষী কার্লাইল তাই তার 'On the choice of books' প্রবন্ধের এক জায়গায় বলেছেন, "The true university of our days is the collection of books.'
উপসংহার ঃ কবি ওমর খৈয়াম বেহেশতের আসবাবপত্রের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কাব্যগ্রন্থের কথা ভোলেননি—রুটি, মদ হয়তো নিঃশেষ হয়ে যাবে, শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়বে, কিন্তু অমর কাব্য তার সাথে থাকবে অনন্ত যৌবনা সঙ্গিনীর মতো।
সুতরাং, বই মানুষের আনন্দের সঙ্গী। কত মানুষের পথ চলায় পদচিহ্ন পড়েছে এই পৃথিবীর বুকে—তার ছন্দকে ধরে রেখেছে বই। কত ভাষায় মানুষ কথা বলেছে—তার সঙ্গীত ধ্বনি স্তব্ধ মুখরতায় লিপিবদ্ধ বইয়ের পাতায়। মানুষ যখন নিঃসঙ্গ, একাকী তখন বই তার সেই একাকিত্বকে দূর করে। কে না ভালোবাসে বইকে? যে না ভালোবাসে ভাগ্য তার বিড়ম্বিত। মহৎ আনন্দ থেকে সে বঞ্চিত। তাই তো আজকের দিনের বাণী – 'বই হোক নিত্য সঙ্গী।'
সবগুলো রচনা একসাথে দেখতে এখানে চাপ দিন
ফিউচার ড্রীম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url