ভাবসম্প্রসারণ তালিকা | 10 টি গুরুত্বপূর্ণ ভাবসম্প্রসারণ
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা সবাই কেমন আছো। আশা করি সবাই ভালো আছো। প্রতিদিনের মতোই আজকেও তোমাদের জন্য 10টি গুরুত্বপূর্ণ ভাব-সম্প্রসারণ নিয়ে হাজির হলাম। আজকের ভাব-সম্প্রসারণ গুলোর তালিকা নিচে সূচিপত্রের মধ্যে দেওয়া হলো। ক্লাস ৬ থেকে শুরু করে ১২ পর্যন্ত এই ভাব-সম্প্রসারণ গুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত গুগল বা ইউটিউবে সার্চ করে বিভিন্ন রকম ভাব-সম্প্রসারণের নাম লিখে। তাই আমি তাদের সুবিধার্থে আমরা ওয়েবসাইটে ৩০০টিরও বেশি ভাবসম্প্রসারণ প্রকাশিত করেছি।
তোমার আমার ওয়েবসাইটের মধ্যে প্রায় সকল ধরনের ভাবসম্প্রসারণ পেয়ে যাবে । তাছাড়া পড়াশোনা সম্পর্কিত যেকোনো কিছু আমার ওয়েবসাইটে পেয়ে যাবে।
সূচিপত্রঃ ভাবসম্প্রসারণ তালিকা | 10 টি গুরুত্বপূর্ণ ভাবসম্প্রসারণ
- প্রয়োজনে যে মরিতে প্রস্তুত, বাঁচিবার অধিকার তাহারই
- বিদ্যার সাধনা শিষ্যকে নিজে অর্জন করতে হয়। গুরু উত্তরসাধক মাত্র
অর্থসম্পদের বিনাশ আছে, কিন্তু জ্ঞানসম্পদ কখনো বিনষ্ট হয় না
মূলভাব ঃ জ্ঞান অমূল্য সম্পদ। এটি ক্ষয়হীন চিরন্তর ও অবিনশ্বর। অর্থসম্পদের অতি প্রয়োজনীয় তবে এ সম্পদের বিনাশ বা ক্ষয় আছে। অর্থসম্পদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি হলেও জ্ঞানসম্পদের প্রয়োজনীয়তা অবিনাশী।
সম্প্রসারিত ভাব ঃ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য অর্থ সম্পদের যে প্রয়োজন আছে এ কথা অনস্বীকার্য। এই অর্থসম্পদ আহরণের জন্য মানুষ নিরন্তর কঠোর পরিশ্রম করে চলেছে। এমনকি আজকের দুনিয়া ও ছুটছে অর্থসম্পদের পেছনে। কিন্তু এই অর্থ সম্পদ চিরস্থায়ী নয়, এর ক্ষয় বা বিনাশ আছে। যার কারনে বাস্তবে দেখা যায় বিত্তবান ব্যক্তি সময়ের ব্যবধানে অঢেল বিত্তের অধিকারী হয় আবার অনেক সময় সব হারিয়ে পথে দাঁড়ায়। কিন্তু জ্ঞান সম্পদ কখনো হারানোর ভয় থাকে না।
বরং উত্তরোত্তর জ্ঞানের প্রসার ঘটে। মেধা-মনন, প্রতিভা তথা জ্ঞান এক ধরনের সম্পদ। এ সম্পদ মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে। মানুষকে আলোর পথে সুন্দরের পথে এগিয়ে চলতে সাহায্য করে। এ সম্পদ কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না। জীবন যতদিন থাকবে ততদিন এই সম্পদ ছায়ার মতো ব্যক্তির সকল বাধা-বিপত্তি দূর করতে সাহায্য করে। জ্ঞান মানুষকে অর্থের মহো থেকে রক্ষা করে, অর্থের নেশায় যেন পশুর মতো অমানুষে পরিণত না হয় সেই দিকনির্দেশনা দেয়। শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দের বোধ জাগ্রত করে।
শিক্ষার ফলেই মানুষ বুঝতে পারে “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু”। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে জ্ঞানের ভূমিকা প্রধান, অর্থ সম্পদ সেখানে প্রয়োজন হিসেবে কাজ করেছে। জ্ঞান সম্পদ মানুষকে অমরত্বদান করে, মানুষের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে। কিন্তু অর্থ সম্পদের অধিকারী ব্যক্তি মৃত্যুর পর মন থেকে বিলীন হয়ে যায়। জ্ঞানী মানুষকে স্মরণীয়-বরণীয় করে তোলে, অর্থবিত্ত কখনো তা পারে না। অতএব, যেকোনো মূল্যে জ্ঞান সম্পদ অর্জন করতে হবে।
মন্তব্য ঃ জ্ঞান নামক অমূল্য সম্পদ যুগের পর যুগ পৃথিবীতে টিকে থাকবে। কিন্তু অর্থ সম্পদ আজ আছে, কাল নেই। তাই সকলেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত অঢেল অর্থ নয় বরং প্রচুর জ্ঞান আহরণ করা।
জাতীয় জীবনে সন্তোষ এবং আকাঙ্ক্ষা দুয়েরই মাত্রা বেড়ে গেলে বিনাশের কারণ ঘটে
মূলভাব ঃ মানুষের জীবনে পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি ও সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা কোনোটিই শুভ নয়। এ দুইয়ের মাত্রা বেড়ে গেলে জীবনে বিনাশ ও বিপর্যয় নেমে আসে।
সম্প্রসারিত ভাব ঃ সীমাহীন অভাববোধ যেমন মানুষকে কখনো মানসিক শান্তি দিতে পারে না। একথাটি ব্যক্তি জীবনের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনই জাতীয় জীবনের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। কেননা মানুষের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গেলে অপ্রাপ্তি বেড়ে যায় আর অপ্রাপ্তি বেড়ে গেলেই সমাজে আবির্ভাব ঘটে দুর্নীতি, অন্যায় ও নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপের। এ কারণে জাতীয় স্বার্থকে সব সময় ব্যক্তি স্বার্থের উপরে রাখতে হবে।
আরো পড়ুন ঃ পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি
অনুরূপভাবে নিজেদের অবস্থান নিয়ে মানুষের মনে যদি সন্তোষ বোধ বেড়ে যায় তাহলে সে আর নিজের উন্নতির কথা চিন্তা করে না। ধীরে ধীরে সে নিজের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন ও কর্ম বিমুখ হয়ে পড়ে। আর জাতীয় ক্ষেত্রে এ সন্তুষ্টি অভিশাপ স্বরূপ। কোনো জাতি যদি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন হয়ে পড়ে, তবে সে জাতির উন্নতি সম্ভব নয় এবং অন্য কোনো বিষয়ে পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট হলে চলবে না।
নিজেদের অবস্থানকে আরও বেশি সুদৃঢ় করার একটা প্রবণতা আমাদের থাকতে হবে। নিজের অধিকার, দেশের অধিকার আদায়ে সদা সচেতন থাকতে হবে। একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের ব্যক্তি জীবনের উন্নতি মানে আমাদের সমাজের উন্নতি। আর সমাজের উন্নতি মানে দেশের উন্নতি। তাই পরিপূর্ণ সন্তুষ্ট হয়ে আমরা নিজেদের এবং আমাদের দেশের অগ্রগতিকে যেন বাধাগ্রস্ত না করি।
মন্তব্য ঃ জীবনে অতিমাত্রায় আকাঙ্ক্ষা যেমন ভালো নয়, তেমনই নিজের অধিকার সম্পর্কে অতিমাত্রায় উদাসীনতাও কাম্য নয়। কারণ এ দুটি জিনিস বেড়ে গেলে ব্যক্তি জীবনের ন্যায় জাতীয় জীবনেও বিনাশ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব
মূলভাব ঃ মানুষের নিজের ও সমাজের কল্যাণ এবং মুক্তি সাধনে জ্ঞানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু জ্ঞানের স্বাভাবিক বিকাশ যেখানে রুদ্ধ হয়, বুদ্ধির বিকাশও সেখানে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে সেখানে মুক্তির পথও রুদ্ধ হয়ে যায়।
সম্প্রসারিত ভাব ঃ মানব সভ্যতার অভাবনীয় উন্নতির পেছনে রয়েছে মানুষের জ্ঞান-জিজ্ঞাসা। জগৎ ও জীবনের রহস্য অনুসন্ধান করতে গিয়েই মানুষ উত্তরোত্তর আবিষ্কার করে চলেছে নতুন নতুন জিনিস, উৎপাদন করেছে নতুন নতুন কৃষি জাত ও শিল্পজাত পণ্য। আর এসবের নতুন নতুন উপযোগিতা সৃষ্টির মধ্যে নিয়ে নিজের ও সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধন করে যাচ্ছে। অন্যদিকে, জ্ঞানকে পুঁজি করে দেশে দেশে, কালে কালে মানুষ শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা করে যাচ্ছে। আর শিল্প সংস্কৃতির চর্চার মধ্যে দিয়ে মানুষ মানুষের হাসি কান্না, সুখ দুঃখ ও ভালোলাগা, ভালোবাসার রহস্য উদঘাটনে নিয়োজিত থাকছে।
এতে করে মানুষের দুঃখ কষ্ট প্রশমনের মধ্য দিয়ে আত্মিক কল্যাণ সাধিত হচ্ছে। মানুষ জীবন বাস্তবতাকে সহজে মেনে নিতে পারছে। অন্যদিকে, পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কালে নানা রকম অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অন্ধবিশ্বাস এবং নানা রকম ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার জ্ঞানের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। আর যে সমাজে জ্ঞান সীমাবদ্ধ অর্থাৎ জ্ঞান বিকাশের সুযোগ নেই, সেখানে বুদ্ধিও আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে সে সমাজের মানুষগুলোকে অন্ধকারেই দিনাতিপাত করতে হয়; মুক্তির স্বাদ লাভ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
আরো পড়ুন ঃ ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়
এই একবিংশ শতাব্দীতে অনেক সমাজের মানুষ বিশ্বাস করে যে, ডায়রিয়া আমাশয় হলো ওলাবিবি নামক দৈত্যের কুদৃষ্টির ফল; অনেক সমাজের মানুষ মনে করে যে শুভ দিন-ক্ষণ না দেখে কোন কাজে নামলে শত চেষ্টার পরেও সে কাজে সফলতা লাভ করা যায় না। আবার অনেক রক্ষণশীল পরিবারের লোকেরা মনে করে যে, মেয়েদের স্কুল কলেজে গিয়ে শিক্ষা লাভ করা ধর্মীয় অনুশাসনের পরিপন্থী। কিন্তু এগুলো বুদ্ধির দ্বারা সমর্থিত কিনা তা মানুষ যাচাই করে দেখে না।
মন্তব্য ঃ প্রত্যেক্ষণ ও যাচাই ছাড়া কোন কিছুকে গ্রহণ বা বর্জন করা উচিত নয়। যে সমাজের মানুষ জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে যাচাই না করে কেবল অন্ধ বিশ্বাস ও অযৌক্তিক ধারণার ভিত্তিতে গ্রহণ কিংবা বর্জন করে, সেই সমাজের মানুষের পক্ষে বুদ্ধির বিকাশ সাধন কিংবা মুক্তির স্বাদ গ্রহণ--- কোনোটিই সম্ভব নয়।
দুঃখের মতো এত বড় পরশপাথর আর নাই
মূলভাব ঃ দুঃখের স্পর্শে মানুষের স্বীয়সত্তা ও অন্তর্গত শক্তি জাগ্রত হয়। দুঃখের মধ্য দিয়ে মানুষ সত্যিকার মনুষ্যত্বকে লাভ করে। দুঃখের পরশেই মানুষের বিবেক মহান হয়।
সম্প্রসারিত ভাব ঃ দুঃখ কষ্টের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই মানুষের মধ্যে জন্ম নেই প্রজ্ঞা ও মহত্ত্বের। দুঃখের করুণ দহন শেষে যে সুখ আবির্ভূত হয়, তা অনাবিল ও অতুলনীয়। দুঃখের আগুনই মানুষের মনুষ্যত্ব ও বিবেককে খাঁটি সময় পরিণত করে। পৃথিবীর সব মূল্যবান সম্পদ দুঃখের বিনিময়েই অর্জিত হয়েছে। দুঃখ ছাড়া প্রকৃত সুখ অর্জন সম্ভব নয়। সুখের অনুভূতি বুঝতে হলে আমাদের দুঃখকে আপন করে নিতে হবে। দুঃখ না পেলে সুখের উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। মনীষীরা দুঃখকে পরশ পাথরের সাথে তুলনা করেছেন।
পরশপাথরের ছোঁয়ায় লোহা যেমন সোনায় পরিণত হয়, তেমনই দুঃখরূপ পরশ পাথরের ছোঁয়ায় মানুষের সব গ্লানি দূর হয়ে যায়। ফলে মানুষ লাভ করে জীবনের সার্থকতা। জগতের সব সাফল্যের সাথে জড়িয়ে আছে সীমাহীন দুঃখের মর্মান্তিক ইতিহাস। বাংলা একটি প্রবাদ আছে__কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না। দুঃখ কষ্ট, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অধ্যবসায় ছাড়া জীবনে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহণ অসম্ভব। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন__দুঃখই জগতে একমাত্র সকল পদার্থের মূল্য। মাতৃস্নেহের মূল্য দুঃখে, প্রতিব্রতের মূল্য দুঃখে, বীর্যের মূল্য দুঃখে, পুণ্যের মূল্য দুঃখে। সুতরাং, দুঃখকে বর্জন করা অসম্ভব।
মন্তব্য ঃ দুঃখ মানুষের সকল জড়তা ও দৈন্য দূর করে তাকে করে সুন্দর। দুঃখের ভেতর দিয়েই মানুষ জীবন সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে। সুতরাং, জাগতিক সকল প্রাপ্তির পূর্বশর্ত দুঃখের পরশ।
ধনের মানুষ মানুষ নয়, মনের মানুষই মানুষ
মূলভাব ঃ সকলের ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকে যে মানুষ সেই মানুষই প্রকৃত মানুষ; ধন সম্পদের গড়া মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষ নয়। বরং যার একটি উদার মন আছে সেই মানব সমাজের আদর্শ হিসেবে বিবেচ্য।
সম্প্রসারিত ভাব ঃ ধন সম্পদ থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে পরোপকারী মন থাকতে হবে। পরোপকারী মন না থাকলে বিত্তবান মানুষ, সাধারণ মানুষের কোনো কল্যাণে আসে না। তাই সাধারণ মানুষের ভালোবাসা থেকে সে হয় বঞ্চিত। মৃত্যুর সাথে সাথে তার ঐশ্বর্যের পরিসমাপ্তি ঘটে। কেউ তাকে মনে রাখতে চাই না। কিন্তু ধন-সম্পদ হীন মানুষ সবার কাছে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পেতে পারে, যদি তার একটি পরোপকারী মন থাকে।
বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ব্যক্তির যদি সংকীর্ণ মন থাকে তবে ওই ব্যক্তির ঐশ্বর্যের কোন মূল্যই নেই জনসাধারণের কাছে। কারণ তার দ্বারা সমাজের আদৌ কোনো কল্যাণ সাধিত হয় না। মৃত্যুর সাথে সাথে এই ব্যক্তিও বিলীন হয়ে যায় মানুষের মন থেকে। কিন্তু পরোপকারী মানুষ বেঁচে থাকে মানুষের হৃদয়ের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে।
মন্তব্য ঃ ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তিরা মানুষের উপর দৃশ্যত প্রভাব ফেললেও তারা মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান করে নিতে পারে না, যদি তাদের পরোপকারী মন না থাকে। পরোপকারী মন যাদের আছে তারাই প্রকৃত মানুষ বলে বিবেচ্য।
মঙ্গল করিবার শক্তিই ধন, বিলাস ধন নহে
মূলভাব ঃ মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গল সাধন কর্ম ঐশ্বর্য দ্বারা সম্ভব। যে ঐশ্বর্য মানুষের মঙ্গল সাধনের সমর্থ তা-ই প্রকৃতপক্ষে ধন, বিলাসিতায় ব্যয়িত অর্থ প্রকৃত ধন নয়। বরং পরোপকারে নিয়োজিত করলে তার অর্জন ও ব্যয়ের সার্থকতা প্রমাণিত হয়।
সম্প্রসারিত ভাব ঃ জগতের যাবতীয় মঙ্গল কাজের নেপথ্যে রয়েছে অর্থ । অর্থ ছাড়া কোনো কাজই সম্পন্ন করা যায় না। আবার উপার্জিত অর্থ বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে সমাজ বা জগতের যেমন কোনো কল্যাণ সাধিত হয় না, ঠিক তেমনই বিপুল অর্থের পাহাড় শুধু ধনভান্ডারে জমা রাখলেও সেই অর্থ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। কাজেই বিবেচনা করে উপার্জিত অর্থ ব্যয় করা উচিত। সঞ্চয় বা কৃপণতা কোনোটার মাঝেই অর্থ বা ধন-সম্পদের সার্থকতা নেই। সদ্ব্যবহারের মাঝেই রয়েছে এর পরিপূর্ণ সার্থকতা। কৃপণতা বা বিলাসিতা দিয়ে অর্থের সদ্ব্যবহার হয় না।
যে ধন সম্পদ দিয়ে সমাজের সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হয় না, কিংবা যে ধন সম্পদ দিয়ে বিলাসের বন্যায় গা ভাসিয়ে শুধু খেয়াল চরিতার্থ করা হয়, সে ধন সম্পদ নিত্যান্তই মূল্যহীন। মানবকল্যাণ ও সামাজিক মঙ্গল সাধনের উদ্দেশ্যেই ধন-সম্পদ বা অর্থের জন্ম। কাজেই মানুষ ও সমাজের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে অর্জিত অর্থই সম্পদ। বিলাসিতা বা অপব্যায়ের উদ্দেশ্যে সঞ্চিত অর্থ প্রকৃতপক্ষে ধন হিসেবে বিবেচ্য নয়। সমাজের চারদিকে যত দরিদ্র অসহায় মানুষ আছে তাদের মঙ্গলার্থে অর্থ ব্যয় করা উচিত। নিজের বিলাসিতায় সকল অর্থ ব্যয় করে দরিদ্র মানুষকে বঞ্চিত করার মাঝে কোনো সার্থকতা নেই।
মন্তব্য ঃ যে অর্থ মানুষের কল্যাণকর্মে ব্যয় হয় না, সেই অর্থের কোনো সার্থকতা নেই। মানব কল্যাণে ব্যয় করা সম্পদই ধন। তাই অর্জিত অর্থকে মানব কল্যাণে ব্যয় করা উচিত।
স্পষ্টভাষী শত্রু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালো
মূলভাব ঃ স্পষ্টভষী শত্রু প্রতিপক্ষের দোষ ত্রুটি উন্মোচন করে প্রতিপক্ষকে শুধরানোর সুযোগ করে দেয়। অন্যদিকে, নির্বাক মিত্র বন্ধুর ভুল না ধরিয়ে দিয়ে তার জীবনের পতনকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। নির্বাক মিত্র সুবিধা ভোগী চরিত্রের হয় বলে বন্ধুর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। অন্যদিকে, স্পষ্টভাষী শত্রুর দ্বারা প্রতিপক্ষ উপকৃত হয় চূড়ান্ত বিচারে।
সম্প্রসারিত ভাব ঃ মানুষের জীবনে চলার পথে নির্ভরযোগ্য বন্ধুর প্রয়োজন। জীবনে চলার পথে না চাইলেও মানুষের শত্রু সৃষ্টি হয়। বন্ধু এবং শত্রুর বৃত্তের ভেতরেই মানুষকে তার জীবন পরিচালিত করতে হয়। তবে কে যে আসল বন্ধু, এ যে শত্রু সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ করে মানুষকে পথ চলতে হয়। শত্রু মিত্র সম্পর্কে মূল্যায়ন যদি সঠিক না হয় তাহলে মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সাধারণ বিচারে মানুষের কাছে শত্রু কাম্য নয় বরং বন্ধু পরম আকাঙ্ক্ষার ধন।
কিন্তু শত্রু যদি স্পষ্টভাষী হয় তাহলে দেখা যায়, সে শত্রু নির্বাক বন্ধুর চেয়ে ভালো। কেননা নির্বাক বন্ধু মানুষের দোষ ত্রুটি সম্পর্কে মন্তব্য না করে, বন্ধুর হ্যাতে হ্যাঁ মিলিয়ে সে মূলত সুবিধাভোগী চরিত্রের ভূমিকা পালন করে প্রকৃতপক্ষে মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যেই রাখে। অন্যদিকে, স্পষ্টভাষী শত্রু মানুষের দোষ ত্রুটিগুলো তুলে ধরে প্রকৃতপক্ষে তার উপকার করে। স্পষ্টভষী শত্রুর এ ধরনের ভূমিকার কারণে মানুষ নিজেকে শুধরিয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ লাভ করতে পারে।
মন্তব্য ঃ জীবনের প্রয়োজনে উপকারে না এলে কোনো সম্পর্কেরই যথার্থ মূল্যায়ন হয় না। স্পষ্টভাষী শত্রুর দ্বারা মানুষের উপকার হয় বলে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, স্পষ্টভাষী শত্রু নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালো
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস
মূলভাব ঃ মানুষের নিরন্তর পরিশ্রম করার মানসিকতা ও জানার আগ্রহ মানুষকে সভ্যতার অগ্রযাত্রায় এগিয়ে দিয়েছে। সে এখন আর অদৃষ্টের হাতে সমর্পিত নয়। মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা।
সম্প্রসারিত ভাব ঃ একটা সময় ছিল মানুষ অদৃষ্টের উপর পুরোপুরি নির্ভর করত। সে বিশ্বাস করত পূর্বজন্মের কর্মফলই এ জন্মের কর্মের নিয়ন্ত্রক ও নিয়ামক। কিন্তু এ বিশ্বাস এখন আর নেই। মানুষের নিরন্তর প্রচেষ্টায় বিজ্ঞান খুলে দিয়েছে অতীতের অনেক অজানা রহস্যের দ্বার। মানুষ চাঁদে গেছে, আবিষ্কার করেছে গ্রহ, তারা, নক্ষত্রপুঞ্জ। জেনে গেছে এদের প্রকৃত রহস্য।
আয়ত্ত করেছে অজানা শক্তিকে। প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেকে। এ কথা সত্য, যে বিষয়গুলোর রহস্য আবিষ্কার সম্ভব হয়নি সেগুলোর ক্ষেত্রে অদৃষ্ট কথাটি থেকে যাচ্ছে। তবে হাজার হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস পরিক্রমায় সময় ও সভ্যতার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আজকের দিনে মানুষ আর ভাগ্যের লিখন বা কপালের দোহাই দিয়ে বসে থাকতে রাজি নয়। জানার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা আর নিরন্তর প্রচেষ্টা অনেক অজানা রহস্যকে মানুষের দৃষ্টিসীমার আয়ত্তে এনে দিয়েছে। নিয়তি নির্ভরতা মানুষকে অকর্মণ্য ও অলস করে তোলে।
অসম্ভব কাজকে নিয়তির খেলা আখ্যা দিয়ে বর্জনের কোনো সুযোগ নেই। বরং আপন অভিজ্ঞতা দিয়ে মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে, কর্মধারা সকল অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তার অসাধ্য কিছুই নেই। অদৃষ্টকে অলীক বা ভুল প্রমাণিত করে কর্মের মন্ত্র দিয়েই সে জগৎ জয় করেছে। এতে সে হয়েছে ব্যর্থ কিংবা সফল। কিন্তু ব্যর্থতার গ্লানিও তাকে থামিয়ে দেয়নি বরং তা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে হয়ে উঠেছে আরও বেশি অধ্যবসায়ী।
মন্তব্য ঃ আত্মবিশ্বাসী মানুষ অদৃষ্টের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে না বরং জানার নিরন্তর প্রচেষ্টায় অদৃষ্টকে পরিহাস করে সংগ্রামী হয়ে ওঠে। অদৃষ্টের প্রতি আস্থাশীলতা মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে।
বিঃদ্রঃ [এই সবগুলো ভাবসম্প্রসারণ পাঞ্জেরী বই থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে]
ফিউচার ড্রীম আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url